Saturday, July 18, 2020

গল্প ঘটনার আঠাশ ঘণ্টা বাদে

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
ঘটনার আঠাশ ঘণ্টা বাদে

ঘটনার চার ঘণ্টা পরে
আজকের সকালটা যে অন্যরকম তা বোঝার জন্য রেডিও চালাতে হয় নি নগেনের। ভোররাতের দিকে বাইরে হইচই শুনে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গতকাল অনেক রাত করে ফিরেছে। কলকাতার বাইরে কাজের ডিউটি ছিল। ভেবেছিল বেলা করে উঠবে। সকালের ডিউটি নেবে না। কিন্তু কপাল মন্দ। ঘুমের মধ্যেই বাইরে হইচই হচ্ছে শুনে তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে দাড়াল। বাইরে এসে যা দেখল, তাতে কিছুক্ষণ মুখে কোন কথা এলো না।
সবুজ, বেগুনী, নীল – নানান রঙের আলোয় রাতের আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। চারদিক দিনের মতো উজ্বল হয়ে উঠেছে। রাস্তার সব আলো নিভে গেছে। যেন কোন ম্যাজিশিয়ান আকাশের খোলা মঞ্চে ইচ্ছেমতো রঙের খেলা দেখাচ্ছে। অবাক হয়ে ও তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। অনেকক্ষণ।
তার পর প্রায় চার ঘণ্টা কেটে গেছে। এখনও চারদিকে
লোডশেডিং। বাইরে এখনও অনেক লোক হতবাক হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। চারদিকে ব্ল্যাকআউট। কেউই কিছু জানে না। শোনা যাচ্ছে ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে।
পাশের বাড়ীর মহিমদাদু কলতলায় দাঁড়িয়ে নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বলে বেড়াচ্ছে- বুঝলি, এ হল কলির শেষ। এতো অন্যায়, এতো অন্যায়। আর কতোদিন পৃথিবী সইবে বলো।শেষ সময় এসে গেছে। তা না হলে রাতের আকাশে ওরকম ভূতের আলোর নেত্য দেখতে হয়!
মহিমদাদুর ছেলে বেশ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। দুই নাতী- নাতনি আর বউমা নিয়ে এখন মহিমদাদুর কষ্টের সংসার। সেসব থেকেই রাগ বোধহয়।
কিন্তু এটা ঘটনা যে চারদিকে সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে।
নগেনের দু – তিনজন কলেজপাস বন্ধু আছে। তারা যদি কিছু বলতে পারে। কিন্তু ফোন করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল নগেন। নেটওয়ার্ক নেই।ফোন করা যাচ্ছে না। বাড়ী থেকে বেরিয়ে চেনাজানা কয়েকজনের ফোন থেকে ফোন করতে গিয়ে দেখল, তাদের ফোনেরও একই হাল। কারুরই ফোনে নেটওয়ার্ক নেই।
বাড়ী থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলে বাজার। আজ হাট বসার দিন। কিন্তু হাট আজ তেমন জমে নি। মাত্র কয়েকজন তরিতরকারি ,মাছ নিয়ে বসেছে। বাজারে স্থানে স্থানে জটলা। সবার মুখে একই আলোচনা। কি হয়েছে? কি ব্যাপার?
পার্টির দাদারাও ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রামু এ পাড়ার এক উঠতি দাদা। সিগারেটের ধোঁয়া নগেনের মুখের উপরে ছেঁড়ে রামু বলে উঠল- নিউক্লিয়ার অ্যাটাক। চীন ভারতকে আক্রমণ করেছে। আর কি? আমি আগেই জানতাম। কিছু করতে পারলাম না এই যা আফশোষ রয়ে গেল।
- সে কি? আপনি কি করে জানলেন?
- আরে সেসব খবর আমাদের কাছে ঠিক চলে আসে। সব খবর তো আর তোদের দেওয়া যায় না। তবে এতো তাড়াতাড়ি ব্যপারটা যে ঘটবে তা আন্দাজ করতে পারি নি। বুঝলি, শেষ দিন এসে গেছে। কাল আর দেখব কিনা তাই সন্দেহ। তা পুজোর চাঁদাটা আজই দিয়ে দিস।– বলে হড়বড়িয়ে অন্যদিকে এগিয়ে গেল।
নগেনের এখনও বিয়ে হয় নি। ও একাই থাকে এই পাঁচমুড়ি গ্রামে। এখানে ও নতুন একটা ছোট বাড়ী করেছে। এই দুবছ্র হল। সত্যিই কি তবে আজ শেষ দিন?
যে মানুষটার জন্য পায়ের নিচে মাটি পাওয়া গেছে, শেষ দিনে তাকে না দেখলে কি করে হবে? আজকের দিনে সেই দেবতুল্য মানুষটা ঠিক আছেন তো? শুনেছে আগের বাড়ী ছেড়ে উনি এখন এক চব্বিশ তলার ফ্ল্যাটের উপরতলায় একা থাকেন। কোন বড় বিপদে পড়েন নি তো?
নগেন মুহূর্তে ঠিক করে ফেলল কলকাতায় যাবে সেই গৌতমবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। গাড়ী চালিয়ে যেতে আড়াই ঘণ্টা লাগবে। আজকের এই গাড়ী- বাড়ী সবই ওনার জন্যই। না হলে নগেনের যে কি হত বলা মুস্কিল।
ওনার বাড়ীতে গাড়ী চালাত নগেন। বাবাকে খুব কম বয়সে হারায় নগেন। বাড়ীতে রোজগেরে অন্য কেউ না থাকায় মাত্র আঠেরো বছর বয়সে কাজে নেমে পড়তে বাধ্য হয়। গাড়ী চালানোর হাত ভালো ছিল না। সবে তখন শিখেছে। তবু গৌতমবাবু ওর অবস্থা দেখে ওকে ওনার দামী গাড়ী চালানোর ভার দেন। একই সঙ্গে ওনার এটা পছন্দ ছিল না যে নগেন পড়াশোনা না করে সারাজীবন শুধু গাড়ী চালিয়ে যাবে। এজন্য একটা ডিপ্লোমা কোর্সেও ভর্তি করে দেন। এমন কি মাইনে না কমিয়ে ডিউটির সময় অনেক কম করে দেন যাতে নগেন পড়াশোনা করার সময় পায়।
বলতেন – বুঝলি, ইচ্ছে থাকলে সব কিছুই করা যায়।
কয়েক বছর পড়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে পড়াশোনা ওর আর হল না। ওর মাথায় ঢুকত না। বরঞ্চ ওই গাড়ীর কলকব্জার ব্যাপারটা ওর মাথায় সহজে ঢুকত। শেষে ঠিক করে নিজে গাড়ী কিনে ব্যবসা করবে। তাতেও গৌতমবাবু উৎসাহ দেন। ওকে প্রায় জোর করে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন যাতে ও নিজে একটা গাড়ী কিনতে পারে।
সেই শুরু। কিছুদিন পরে রোজগার করে সে টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিল নগেন। নেন নি গৌতমবাবু।
আজ উনি একা দক্ষিণ কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। এই বিপদের দিনে যদি আজ নগেন না ছুটে যায় ওনার কাছে, তবে আর কবে যাবে?
গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নগেন।
ঘটনার আট ঘণ্টা বাদে
ভেবেছিল গাড়ীতে করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। কয়েক মাইল যেতেই রাস্তায় ট্রাফিকজ্যামে আটকে পড়ল নগেন। সার দিয়ে গাড়ী পরপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। কি ব্যাপার বুঝতে গাড়ী থেকে নেমে একটু হেঁটে এগিয়ে গেল নগেন। মাইলের পর মাইল জুড়ে লাইন। পেট্রোল পাম্পে তেল দেওয়া নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নিয়ে কিছু দূরে রাস্তায় গণ্ডগোল বেঁধেছে। তেল নাকি আগামী কয়েক দিন পাওয়া যাবে না।
প্রায় সব দোকানেই বিশাল লাইন। একটা মুদীর দোকানের সামনে তো রীতিমত মারপিট চলছে। বাইরে বড় লাইন পড়ে গেছে। সবাই ঢুকতে চায়। বেশ কিছু দিনের জন্য খাবার কিনে রেখে দিতে চায় এ পরিস্থিতিতে। কি হবে কেউ জানে না! নানান খবর বাতাসে উড়ছে।
এখনও সর্বত্র ব্ল্যাক আউট। সব ট্রান্সফরমার নাকি পুড়ে গেছে। তাই রাস্তায় জায়গায় জায়গায় জটলা।
সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। তবু তার মধ্যে ধৈর্য ধরে ঢিকঢিক করে গাড়ী চালিয়ে এগোতে লাগল। অবশেষে এমন একটা জায়গা এল যেখানে গাড়ী আর প্রায় নো নড়নচড়ন। খবর নিয়ে জেনেছে ট্রেনও চলছে না। তাই সব প্রেশার এসে পড়েছে সড়কব্যবস্থার উপরে।
নাহ, গাড়ী নিয়ে আর যাওয়া যাবে না। হেঁটে আর কত সময়ই বা লাগবে! কুড়ি মাইল বাকি আর।
হেঁটে, তারপরে সুযোগ বুঝে বাসে ওঠা গেলে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। গাড়ীটাকে রাস্তার ধারে রেখে হেঁটে এগিয়ে চলল নগেন।
এরকম অবস্থা আগে কখনও দেখে নি। লোকেরা যেন হঠাৎ করে কয়েক শো বছর পিছিয়ে পড়েছে। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, খাবার নেই, জল নেই, কোথাও বিদ্যুৎ নেই।
একটা সময় গৌতমবাবুর অনেক আত্মীয়-বন্ধু ছিল। উত্তর কলকাতার বিশাল বাড়ীতে লোকেদের আনাগোনা সব সময় লেগে থাকত। কিন্তু আজ আর সে দিন নেই। স্ত্রী মারা গেছে বেশ কয়েক বছর। একটা সময় বিশাল ব্যবসা একা হাতে সামলেছেন। এখন ব্যবসার দায়িত্ব ভাইপোর হাতে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসার থেকে দূরে সরে এসেছেন।
অন্যদিন সকালে উঠে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে কিশোরী আমোনকারের বিভাস রাগের সিডিটা প্রথম চালান। বহুদিনের অভ্যাস। কিন্তু আজ মিউজিক সিস্টেমে গান চালু করতে গিয়ে বুঝলেন লোডশেডিং।
একই সঙ্গে বুঝলেন আজকের দিনটা যেন একটু অন্যরকম। একটা অন্যধরণের সবজে - বেগুনী আলো জানলা দিয়ে এসে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
কিছুদিন আগে স্ট্রোকে ওনার শরীরের বাঁদিকটা প্রায় অচল হয়ে গিয়েছে। সাহায্য ছাড়া তাই ঘরে হাঁটাচলা করতে পারেন না। খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। অন্য ঘরের থেকে জল আনাটাও ওনার কাছে আজ একটা অ্যাডভেঞ্ছার।
ওনার চব্বিশ ঘণ্টা দেখাশোনার জন্য দুজন নার্স আছে। প্রথমজন সকাল ছটা হলে চলে আসে। অন্য দিন দেরী করে না। আজ কিন্তু ছটা, সাড়ে ছটা বেজে গেল, তার আর দেখা নেই।অন্যদিকে বহুদিনের কাজের ফুলটাইম লোকটা গতকাল দু দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। খবর পেয়েছে বাড়ীতে মার শরীর খারাপ। আজ সকালে একজন নতুন লোক আসার কথা। তারও দেখা নেই। অবশ্য এখনও সময় আছে।
বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পরে অনেক কষ্ট করে হুইলচেয়ারে উঠে বসে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ড্রয়িংরুমে আধবোতল জল রাখা ছিল। খানিকটা জল খেয়ে হুইলচেয়ারে করে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে এসেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
আকাশ জুড়ে এরকম আলোর খেলা উনি আগে দেখেন নি। যেন প্রকৃতি আবীরের রঙের খেলার মেতেছে। লক্ষ্য করলেন অনেক লোক নিচে খোলা জায়গায় ছোটাছুটি করছে। এতো উপর থেকে তাদের দেখা যায়, যোগাযোগ করা যায় না। এ যেন
এখনকার জীবনেরই একটা ছবি।
কিছু একটা যে বড় ধরণের দুর্ঘটনা হয়েছে, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। লোকে যেন ভীত সন্ত্রস্ত। আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে অনেক লোকের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কিন্তু উনি এটাও জানেন এখান থেকে চেঁচালে ওনার ডাক কেউ শুনতে পাবে না। এমনিতেও এ ধরণের উচ্চবিত্ত ফ্ল্যাটগুলোতে কেউ কারুর সাহায্যের জন্য চট করে এগিয়ে আসে না।
কিন্তু উপায়? এ ফ্ল্যাট থেকে কারুর সাহায্য ছাড়া বেরোবেন কি করে? এখন যদি ওনার নার্স বা কাজের লোকটা না আসে! কেউ কলিং বেল বাজালে উনি রিমোট দিয়ে দরজা খুলে দিতে পারেন। কিন্তু কোথায় কে?
উনি সেলফোন বিশেষ ব্যবহার করেন না। তবু আজ সেলফোন থেকে চেনা-পরিচিতদের ফোন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু খেয়াল করলেন ফোন যাচ্ছে না। অবাক হয়ে দেখলেন ফোনের নেটওয়ারক নেই। ল্যান্ড ফোনটাও ডেড।আশ্চর্য। এরকম তো কখনও হওয়ার কথা নয়। ওনার মতো পৃথিবীরও কি শেষ সময় এসে উপস্থিত?
কি করবেন কিছু না বুঝে সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। চুপ করে হুইল চেয়ারে বসে থাকলেন রঙের খেলা দেখতে।
ঘটনার দশ ঘণ্টা বাদে
প্রথম দিকে ঘটনার আকস্মিকতা শ্রীজাতকে অবাক করে দিলেও, কি হয়েছে খবর পেতে শ্রীজাতর বেশী সময় লাগল না।
একটা বিশাল সোলার স্টরম বা সৌরঝড়। সেই সৌরঝড়ের সঙ্গে অস্বাভাবিক মাত্রায় করোনা মাস ইঞ্জেকশন অর্থাৎ চারজড সৌরকণিকা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকে পড়েছে। একই সঙ্গে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে মিলেমিশে খুব শক্তিশালী তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তার জন্যই পাওয়ার গ্রিডের সব ট্রান্সফরমারগুলো পুড়ে গেছে। একই সঙ্গে স্যাটেলাইটগুলো খারাপ করে দেওয়ায় টেলিফোনের নেটওয়ার্ক চলে গেছে।
মাথা তাই গরম শ্রীজাতর।কতদিন ধরে পারফেক্ট মারডারের প্ল্যান করেছিল।ভুল খবর দিয়ে বুড়োটার বিশ্বস্ত কাজের লোকটাকে গতকাল থেকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আজকের জন্য নতুন কাজের লোকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপর গতকাল শেষ মুহূর্তে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল। একদিনের জন্য নার্সের ব্যবস্থা না করে, ভেবেছিল আজকেই লঙ্কেশকে দিয়ে কাজটা সারবে।
লঙ্কেশের কাজটাও কিছু শক্ত নয়। এমন কি ধরা পড়ারও কোন ভয় নেই। ওর কাজ ছিল শুধু গৌতমবাবুর শোওয়ার ঘরটা রং করার। ঘরের রং করানোর কথা গৌতমবাবুই ক’দিন আগে শ্রীজাতকে বলেছিল। তারপরেই শ্রীজাতর মাথায় আইডিয়া আসে।
রংমিস্ত্রি লঙ্কেশের পক্ষেও জানা থাকার কথা নয় যে ও যে নীল রঙ ব্যবহার করবে তাতে অনেক বেশী মাত্রায় সায়ানাইড আছে। এই নীল রঙের পেন্টে এমনিতেই সায়ানাইড থাকে। এটাতে আরেকটু বেশী ছিল আর কি! এ ব্যাপারে শ্রীজাতর নিজের অভিজ্ঞতা আছে। এক সময়ে রঙ তৈরির ব্যবসা ও করেছে। একই সঙ্গে জানা আছে যে বুড়োটা সবসময় ঘরের জানলা - দরজা বন্ধ করে শোয়। দীর্ঘ দিনের অভ্যেস।
সবই ঠিক ছিল। শুধু বাড়তি সাবধানতার জন্য লঙ্কেশকে আগে থেকে জানানো হয় নি কোথায় রং করতে হবে। অ্যাড্রেসও ইচ্ছে করে আগে থেকে জানায় নি লঙ্কেশকে। কিছুদিন আগে লঙ্কেশকে দিয়ে নিজের বাড়ী রং করানোর সময় প্ল্যানটা মাথায় আসে। নিজের বাড়ীর কাজ এখনও শেষ হয় নি। কিনে আনা রঙের সঙ্গে বিশেষ মাত্রায় সায়ানাইড মিশিয়ে এই স্পেশাল রং নিজের হাতে তৈরি করেছে। সেটা লঙ্কেশের কাছে গতকাল দিয়ে এসেছে। ঘরে রং করে দরজা বন্ধ করে শুলেই ব্যাস। রং থেকে নিষ্কৃত সায়ানাইড গ্যাসে এক ঘণ্টায় কাজ সারা হয়ে যাবে।
কখন কোথায় কাজটা করতে হবে সেটা সকালবেলা ফোন করে জানানোর কথা ছিল। শুধু বলা ছিল আজকেই কাজটা সারতে হবে। আরজেন্ট। যে করে হোক আজকেই করতে হবে। অন্য কোন কাজে লঙ্কেশ যেন হাত না দেয়। কিন্তু সে জানানোর উপায় এখন আর নেই। একমাত্র উপায় গাড়ী নিয়ে লঙ্কেশের বাড়ী গিয়ে জানিয়ে আসা।
এতো দিনের প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মাথা প্রথমে বেশ গরম হয়ে গিয়েছিল।
কিছুদিন বাদে গৌতমবাবুর বন্ধু প্রশান্তবাবু ফিরে এলেই উইল পরিবর্তন হয়ে যাবে।
এই মশলাপাতি- চাল এক্সপোর্টের ব্যবসা গৌতমবাবুই শুরু করেন। গৌতমবাবু সম্পর্কে শ্রীজাতর জ্যেঠা হন। গৌতমবাবু ভাইকে অর্থাৎ শ্রীজাতর বাবাকে অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। কিন্তু ওনার অংশ যদি চ্যারিটিতে দান করে দেন, তাহলে অর্ধেক সম্পত্তি শ্রীজাতর হাতছাড়া হয়ে যাবে। শ্রীজাতর পুরোটা চাই। পুরোটা।
মাথা ঠাণ্ডা করে আরেকবার ভাবল শ্রীজাত।
আচ্ছা, এ পরিস্থিতিতে সেরকম কিছু ব্যস্ততার কোন দরকার আছে কি? এমনিতেও ওই রকম একটা ফ্ল্যাটে একটা মানুষ কতক্ষণ টিঁকে থাকতে পারবে? মনে তো হয় না কাউকে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারবে। এমনিতেও ওই কমপ্লেক্সে গৌতমবাবুর পরিচিত কেউ নেই যে ওনার কথা খেয়াল রাখবে। আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসবে।
ধীরে সুস্থে আজকেই না হয় অন্য যে কোন সময়ে লঙ্কেশকে দিয়ে রঙের কাজটা সারানো যাবে।কাল নার্স এসে গৌতমবাবুর মৃতদেহ আবিষ্কার করবে। এতো কিছুর মধ্যে পুলিসের পক্ষে এ বিষয়ে তদন্ত করাও সম্ভব হবে না। শেষ এরকম বড়সড় সৌর ঝড়ের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫৯ সালে। যাকে বলা হয় ক্যারিংটন ইভেন্ট। তখন এভাবে টেকনোলজি মানুষের ঘাড়ের উপর চেপে বসে নি।না ছিল জিপিএস, না ছিলও সেলফোন, না ছিল ইলেক্ট্রিসিটি। শুধু সেসময় টেলিগ্রাফ সিস্টেম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এখন শুধু একদিনে কত যে লুটপাটের ঘটনা ঘটবে তার কি কোন ইয়ত্তা আছে! পুলিস সেটা সামলাবে, না এরকম একটা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তে লোক লাগাবে। তা ছাড়া এ ভাবে অপরাধীকে ধরার জন্য যে দক্ষতা লাগে, সে দক্ষতা যে কলকাতা পুলিসের নেই – সে ব্যপারে শ্রীজাত নিশ্চিত।
আর ধরবেই বা কাকে? ওই রঙের কোম্পানীর মালিককে যার রঙে ও সায়ানাইড মিশিয়েছে। নিজের মনে হেসে উঠল শ্রীজাত।
আপাতত ওর একটাই কাজ। লঙ্কেশকে খুঁজে বার করা।
ঘটনার ১৬ ঘণ্টা বাদে
এই এতক্ষণে একটা বেলের আওয়াজ যেন পেলেন গৌতমবাবু। ঠিক শুনেছেন কি? এরকম আগেও যেন দুবার শুনেছেন। দরজার কাছে গিয়ে কাউকে দেখতে পান নি। অথচ অন্য কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই। বাইরে অনেক কষ্টে বেরিয়ে একবার দরজা খুলে গিয়ে দেখেছেন লিফট কাজ করছে না। পাশে শর্মার ফ্ল্যাট। কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। যাবেন কোথায়?
সকাল থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয় নি। তাই শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। জলতেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কোনও কলে জল নেই।
তবু আস্তে আস্তে হুইল চেয়ার নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন- কে? কে?
- আমি নগেন। আপনার গাড়ী চালাতাম। মনে পড়ে কাকু?
ছেলেটার গলা চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা, নগেন। কত বছর আগে ছেলেটা গাড়ী চালাত। অনেক কষ্ট-করশত করে বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কোন রকমে দরজা খুলে দিলেন গৌতমবাবু।
কিন্তু খুলেই পড়ে যাচ্ছিলেন। নগেন ঘরে ঢুকেই গৌতমবাবুকে জড়িয়ে ধরে কোনরকমে সামলে নিল। তারপরে ওনাকে ধরে সোফায় এনে বসাল নগেন।ও নিজেও ক্লান্ত হয়ে গেছে। লিফট কাজ করছে না। চব্বিশ তলা হেঁটে উঠেছে। তার আগে কুড়ি মাইল পথ হেঁটে এসেছে।
এ ফ্ল্যাটে আগে কখনও আসে নি নগেন। চারদিকে বৈভবের চিনহ। কিন্তু কোথায় যেন তবু শূন্যতা ছড়িয়ে আছে।
বাইরে যে কি তান্ডব চলছে, ঘরের মধ্যে থেকে তা এখনও বুঝতে পারেন নি গৌতমবাবু। সব পাম্প থেমে যাওয়ায় কোথাও পানীয় জলও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কষ্ট করে জল জোগাড় করেছে নগেন। একটা দোকান থেকে অনেক কষ্ট করে সামান্য খাবারও নিয়ে এসেছে।
অশক্ত হাতে খানিকটা জল আর খাবার খেয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে তবে কথা বললেন গৌতমবাবু।
- নেহাৎই খুব খিদে পেয়েছিল, তাই খেলাম। তা না হলে খেতাম না। এতো দিন আসিস নি কেন হতভাগা?- অভিমানী গলায় বলে উঠলেন গৌতমবাবু।
মাথা নীচু করে নগেন বলে উঠল- খুব ভুল হয়ে গেছে। একদিন এসেছিলাম। কিন্তু গেট থেকে ঢুকতে দেয় নি। আপনার ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল না। আপনি বাড়ীতে নেই বলে জানিয়েছিল সিকিউরিটি। তাই ফিরে গিয়েছিলাম। ভয়ে আর আসি নি। এখানকার যা ব্যাপার স্যাপার।
-তা তোর গাড়ী কিরকম চলছে? রোজগার হচ্ছে?
-হ্যা, চলে যাচ্ছে। একা থাকি। ভালোই চলে যায়।
-খুব ভালো। তা তোর কোন সাহায্য লাগবে?
-না, না, আগের টাকাই তো আপনি ফেরৎ নিলেন না। আমার বেশ চলে যাচ্ছে। কোন কিছু লাগবে না।
-আমাকে একটু বাইরের বারান্দায় নিয়ে চল তো।
হুইলচেয়ার ঠেলে গৌতমবাবুকে আবার বাইরে বারান্দায় নিয়ে এল নগেন।
এখন সন্ধে হয়ে গেছে। অন্যদিনের মতো কমপ্লেক্স আজ আলোয় ঝলমল করছে না। পুরো শহরের মতো কমপ্লেক্স এখনও অন্ধকারে ঢেকে আছে।
-এরা জেনারেটর চালায় নি কেন সারাদিন জানি না!
-ওটাও শুনলাম নাকি পাওয়ার সারজে পুড়ে গেছে।
-বেশ হয়েছে। পাশে বস।
নগেন পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে।
নগেনের মাথায় হাত দিয়ে গৌতমবাবু বলে উঠলেন- বুঝলি এতো অন্ধকার না হলে আলো দেখা যায় না। তাই তো আজ তোকে আবার দেখতে পেলাম। নইলে যখন চারদিক আলোয় ঝলমল করে তখন মানুষের দেখা পাই না। - একটু থেমে ফের বলে উঠলেন- মাঝে মধ্যে এখানে আসিস। তা এরকম কতদিন চলবে কিছু শুনলি?
-কেউ এখনও কিছুই জানে না। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম। শুনলাম সূর্য নাকি ক্ষেপে গেছে। কবে শান্ত হবে কে জানে? যতদিন সব স্বাভাবিক হচ্ছে, আমি কিন্তু আপনাকে রেখে এখান থেকে যাচ্ছি না। আপনার কাজের লোক গণেশ এখন নেই? কাউকে তো দেখলাম না!
-গতকাল দু দিনের জন্য বাড়ীতে গিয়েছিল। কাল ফিরে আসার কথা।
- আপনার শরীর কিন্তু একদম ভেঙ্গে গেছে। আগে কত ভালো স্বাস্থ্য ছিল।
কথা বলতে থাকে নগেন। গৌতমবাবু মনে মনে হাসতে থাকেন। এই প্রিয় ছেলেটাকে যখন ড্রাইভার হিসেবে পেয়েছিলেন, তখন ওর বয়স সতেরো কি আঠেরো ছিল। কিন্তু তখনই ওর মধ্যে যে নিঃস্বার্থ সরল চরিত্র দেখেছিলেন, সেটা এখনও রয়ে গেছে। এক যুগ পরেও ছেলেটার অনর্গল কথা বলার অভ্যেসটাও যায় নি। একই সঙ্গে এই কম্পিটিশন আর চালাকির যুগে যে এই বোকাসোকা ছেলেটা টিঁকে আছে, সেটা দেখে উনি নিশ্চিন্ত বোধ করলেন।
মুস্কিল হল যাদের উনি অনেক কিছু দিয়ে যেতে চান, তারাই যে কিছু চায় না। জোর করে দিতে হয়।
ঘটনার আঠাশ ঘণ্টা বাদে
মাঝ রাতে শ্রীজাত যখন ফিরল, তখন ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। সারাদিন লঙ্কেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। ফোন নেটওয়ার্ক এখনও অচল। এখনও ব্ল্যাক আউট চারদিকে। পাওয়ার গ্রিডে যেরকম ক্ষতি হয়েছে, তাতে অবস্থা স্বাভাবিক হতে এখনও বেশ কিছু দিন লেগে যাবে। নেহাৎ বাড়ীতে জেনারেটর আছে, তাই বাঁচোয়া।
শ্রীজাতর উপরমহলে ভালো জানাশোনা আছে। মশলাপাতির ব্যবসা শুধু শুধু রমরমিয়ে চলছে না। ইতিমধ্যেই আগামী দু মাসের জন্য বেশ কিছু খাবার কিনে মজুত করে রেখেছে।বাইরে মার্কেটে অল রেডি বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার আউট অফ স্টক। এখন যে ক’দিন যাবে, সংকট আরও বাড়বে, শ্রীজাতর মতো লোকেদের ফায়দা আর বাড়বে। পেট্রোল ডিজেল ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে না। পাইপলাইনে এর জন্য একটা বড়োসড়ো আগুন লেগে গেছে। যে সব পাইপের মাধ্যমে এসব জ্বালানী আসত, তা নাকি তাই আসা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সব জিনিষের দাম আরও চড়চড় করে বাড়বে। পরিবহণ ব্যবস্থা প্রায় অচল।
রাস্তাতে অনেক জায়গায় গুণ্ডামি, লুঠের খবর পাওয়া গেছে।
আজ আঠেরোটা বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে সারা বিশ্বে, তার মধ্যে একটা দিল্লীতে। আসলে বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বেশ খানিকক্ষণ কাজ করছিল না। জাপানে, আর জার্মানিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেন চেঞ্জ করতে না পারার জন্য বেশ কয়েকটা ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে। রাশিয়ায় একটা তৈল শোধনাগারে এর জন্য বড়সড় দুরঘটনায় হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে।
অবশ্য এখনও অনেক খবর পাওয়াই যায় নি। সবে আসতে শুরু করেছে। নেহাত কিছু টিভি আর রেডিও চ্যানেল এখন কাজ করতে শুরু করছে, তাই কিছু কিছু খবর এখন পাওয়া যাচ্ছে।
সবকিছুর উপরে একটা জগৎ আছে, যেখানে টাকা আর ক্ষমতা থাকলে ভয় পেতে হয় না। শ্রীজাত সেই জগতের লোক। তাই ও ঘাবড়ায় না। বরং এতে শ্রীজাতর অনেক সুবিধা। ওর নিজের ব্যবসা আগামী ক’দিনে যে ফুলে ফেঁপে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একটাই খারাপ খবর তা হল বুড়োটা নাকি এখনও বহাল তবিয়তে আছে। এরকমই খবর পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ প্ল্যান A টা এখনও বহাল রাখতে হবে। এসব কথা ভেবেই বন্ধুদের সঙ্গে একটু বেশী মদ্যপান করে ফিরেছে শ্রীজাত।
সোজা শোওয়ার ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পারল। আজ এসি চলবে না। জেনারেটরে শুধু আলো- পাখার ব্যবস্থা আছে। পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়ল।
চাকর এসে জানাল লঙ্কেশ নাকি বাড়ীতে খোঁজ নিতে এসেছিল। তার নাকি কি একটা দরকারী রঙের কাজ ছিল, কিন্তু সে ব্যাপারে বাবুকে নাকি সারাদিন যোগাযোগ করতে পারে নি।
এই হল ফোনহীন জগত। দুজন দুজনকে খুঁজে বেরিয়েছে সারাদিন। যোগাযোগ করতে পারে নি।
আজকের মতো কাজ সারার ভালো দিন আর ছিল না। আবার আরেকটা দিনের অপেক্ষা।
-বাবু, জানলা খুলে দেব?
-কোনদিন আমি জানলা খুলে শুই- বেরো ইডিয়ট।
আরও কি বলতে যাচ্ছিল চাকরটা। ধমক দিয়ে বার করে দিল শ্রীজাত। এটা একটা বলার সময়! রাত একটা বাজে। নেশা কেটে যাচ্ছে।
বিছানায় শোয়ার খানিকক্ষণের মধ্যে বেঁহুশ হয়ে ঘুমোতে শুরু করে দিল। রাতের দিকে মিষ্টি একটা গন্ধ পেল। অ্যালমন্ডের। ভারী হাল্কা সে গন্ধ। গভীর, আরও গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল শ্রীজাত।
চাকরের শেষ কথাটা ওর আর শোনা হয়ে ওঠে নি। লঙ্কেশ কোথায় রঙ করতে হবে জানতে এসেছিল। এ ঘরের রং খানিকটা বাকি ছিল। বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে এ ঘরেই ওই রঙ করে বিকেলের দিকে লঙ্কেশ বেরিয়ে গেছে। কাজটা আজকেই শেষ করার কথা ছিল যে!
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
১২- ডিসেম্বর- ২০১৭