Sunday, May 31, 2020

আসল অসুখ অনেক গভীরে


আমেরিকায় আজ বিভিন্ন শহরে আগুন জ্বলছে। আমেরিকার প্রায় একশোর মতো শহরে গিয়েছি। পাঁচ-ছয় বছর থেকেছি বিভিন্ন জায়গায়। আমেরিকার সমাজে এই বিভেদ সবসময় আমার চোখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে সেটা আরও বেড়েছে। যে কোন ভালো কনফারেন্সে গেলে, সেখানে সিকিউরিটির লোক ছাড়া বা ট্যাক্সি চালক ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ চোখেই পড়ে না। বিজনেস ক্লাস লাউঞ্জে চোখেই পড়ে না। অনেক পরিকল্পনা ও চেষ্টা সত্বেও খুব কম কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সমাজের উপরের দিকে দেখা যায়। এটা কিন্তু শুধু বর্ণ বিদ্বেষ নয়, তাহলে সেটা ভারতীয়দের সঙ্গেও হতে পারত। এটা শিক্ষা, বুদ্ধি, সংস্কৃতি, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের প্রতিফলন। তার মধ্যে কোভিড পরবর্তী সমাজে বাড়তে থাকা বেকারত্ব, যার প্রভাব ওদের উপরে অনেক বেশী পড়েছে। ভারত ও ইউরোপের কিছু দেশ যেভাবে সবাইকে অনেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপন করে নিয়েছে, সেটাই বোধহয় আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিভেদটা তাই অনেক সময় উপর থেকে অস্পষ্ট দেখালেও, আসল অসুখ অনেক গভীরে।   

Sunday, May 24, 2020

কোভিড- ইতালি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত


নিশ্চয়ই ভাবছেন ইতালিতে করোনা ভাইরাসে কেন এতো মৃত্যু হচ্ছে ! কারণগুলো ভাবলে বুঝতে পারবেন, ভারতেও এই একই জিনিষ হতে পারে। এর জন্য ভয়ে প্যানিক করার দরকার নেই, দরকার সতর্কতা।
দরকার সামাজিক যোগাযোগ যতটা সম্ভব কমিয়ে দিয়ে ঘরবন্দী হয়ে থাকা।
কতদিন? সেটা কেউ বলতে পারবে না। এটা আগামী আট সপ্তাহ হতে পারে, আবার আগামী বারো মাসও হতে পারে। যতদিন আমরা কোন ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিবডি বার না করতে পারি, ততদিন আমরা করোনার করুণার পাত্র।
এবারে ইতালিতে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর কারণগুলো দেখা যাক-
১ অত্যন্ত বেশী সংখ্যক বয়স্ক মানুষ। যারা মারা গেছেন তাদের গড় বয়স ৮১ বছর। (এটা অবশ্য ভারতীয়দের জন্য খাটে না)
২ অত্যধিক ধূমপান করার অভ্যাস(ভারতের মতো)- এটা অবশ্য ভুল প্রমাণিত। ধূমপান সংক্রমণ কমায়।
৩ দাদু -দিদা- ঠাকুরদা- ঠাকুমার সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ।(ভারতের মতো)
৪ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অনেক পরে বুঝতে পারা।(এটা আমাদের এখনও ভারতের ক্ষেত্রে জানা নেই)
৫ প্রয়োজনের তুলনায় কম ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট(ভারতের থেকে ভালো)
৬ আড্ডার অভ্যাস।(ভারতের মতো)
৭ গায়ে হাত দিয়ে কথা বলার অভ্যাস। (ভারতের মতো)
৮ ইতালির এই এলাকায় দূষণ বেশী(ভারতের থেকে ভালো)
৯ শৃঙ্খলাবোধের ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব(ভারতের থেকে ভালো)
জার্মানি বা জাপান কিভাবে মোকাবিলা করছে, তার থেকে অনেক কিছু শেখা যেতে পারে।
এ ঘটনা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্বকে। এ সংকট থেকে উদ্ধারের ক্ষমতা আছে শুধু বিজ্ঞানের আর মানুষের শুভবুদ্ধির।
একটা জিনিষ সবার মনে রাখা দরকার, ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা হল আমাদের আসল ঈশ্বর। তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সেবা করছে। তাদেরকে সবার আগে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে কেউ এ যাত্রায় রক্ষা করতে পারবে না।
অনেকেই জানে না। একবার মনে করিয়ে দিই। শেষ প্যান্ডেমিক যা প্রায় দু বছর ধরে চলেছিল, সেই ১৯১৮-২০ র স্প্যানিশ ফ্লুতে সবথেকে বেশী মারা গিয়েছিল ভারতীয়রাই। তখনকার দিনে প্রায় দেড় কোটি ভারতীয় মারা যায়।
সবাই ভালো থাকবেন। আবার বলছি ভয়ে প্যানিক করার কিছু নেই। তবে যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা সত্যি অভূতপূর্ব। কিন্তু ভারতীয়রা চাইলে পারে না, এমন কিছু নেই।


Saturday, May 23, 2020

গল্প মূর্তি

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
মূর্তি

আজকে শশীর মন খুব খারাপ। আজকেও কোন মূর্তি বিক্রি হল না। উল্টে দোকান থেকে রাজীবকাকুর ধমক খেতে হয়েছে।
-রোজ কতবার করে বলব যে তোর বাবার মূর্তি বিক্রি হয় না! আগেরটা বিক্রি হলে, তবে তো আবার নতুন কিনব? বাবাকে বলিস ঘোড়ার মূর্তি তৈরি করতে বা ঠাকুর-দেবতার মূর্তি। দুর্গার- সরস্বতীর – গণেশের মূর্তি তৈরি করতে পারে। তাও কিছু কেনার লোক থাকে। আর সেটাও যদি না পারে, তো থালা বাটি গেলাস- এসব কাজের জিনিষও তো তৈরি করতে পারে! তাও যদি কোনটা বিক্রি হয়!তোর বাবা যে কি সব হাবিজাবি জিনিষ তৈরি করে, তার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝি না। কাস্টমার কিনবে কেন? তাও তো আমি ওগুলো আমার দোকানে রাখি। নগেনের দোকানে গিয়ে দেখ। রাখবেই না।
মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলেছিল শশী – ঠিক আছে কাকু। কালকে আসব। বাবা বলে রোজ আসতে। যদি কাল বিক্রি হয়ে যায়।আর তোমার কাছে যদি বাবার তৈরি কোন মূর্তি না থাকে! যদি কেউ কিনতে এসে ফিরে যায়?
-না না, আর জ্বালাস না। আর আসবি না। দরকার হলে আমিই জানাব। যা বেরিয়ে যা।এতদিন বিক্রি হল না। কালকেই বিক্রি হয়ে যাবে!– চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল রাজীবকাকু।
শশী আর থাকে নি। বোনের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল। তবে বাড়ী ফিরে যায় নি। একটু দূর থেকে দোকানটার উপরে নজর রেখেছিল। যদি কেউ কিনতে আসে। রাজীবকাকুর দোকানটা বেশ বড়। শহরের মূল বাজারের মধ্যে। তাই টুরিস্টদের বড় একটা অংশ এখানে আসে। ওরা তারই উলটো দিকের রাস্তায় খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রইল।
রোদ বাড়ছে। জ্যৈষ্ঠ মাস। তেতে ওঠা রাস্তার তাপ ছেঁড়া চটির ফাঁক দিয়ে পায়ে লাগছে। খিদেও পাচ্ছে। কিন্তু আজকে ওদের একটা মূর্তি বিক্রি করতেই হবে।বাবার দুটো মূর্তি আছে দোকানটাতে। যে কোন একটা বিক্রি হলেই হল।
দূর থেকে এখনও মূর্তি দুটো দেখা যাচ্ছে। একটা ঘোড়ার উপরে দুটো বাচ্চা ওঠার চেষ্টা করছে। আর ঘোড়াটা যেন অসুস্থ। মাটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সাড়ে তিন ফুটের মত লম্বা ঘোড়াটা, আর উচ্চতায় প্রায় দুফুট।বাবা যখন মূর্তিটা তৈরি করছিল, তখন শশী কে ডেকে ডেকে বলতো – বুঝলি যাদের কথা আমরা বুঝি না, তাদের কথাও বোঝা যায় তাদের খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে। কানের দিকটা লক্ষ্য কর।তাকানোটা লক্ষ্য কর। ঘাড়ের দিকটা লক্ষ্য কর। সামান্য ঢেউ খেলান ভাবটা দেখেছিস।- বলে আবার ঘোড়াটার গলার উপরে হাত বোলাত, আবার মাটির প্রলেপ দিত।
তিন ঘণ্টা বাদেও শশী দেখত, বাবা তখনও ঘোড়ার উপরেই কাজ করে যাচ্ছে।
অন্য মূর্তিটা বোঝা আরও শক্ত। তিনটে লোক তিন ধরণের পোষাকে একটা শুয়ে থাকা অসুস্থ লোককে ঘিরে বসে আছে। আর আঙুল তুলে নিজেদের মধ্যে তর্ক করে যাচ্ছে। শুয়ে থাকা লোকটা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাবার কথা মনে পড়ল শশীর- শুয়ে থাকা লোকটার মুখটা খেয়াল কর। একদিকে যন্ত্রণা ,অন্যদিকে চারদিকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-তা বাবা ওরা ডাক্তার ডাকে নি কেন?
-সব চিকিৎসায় কি আর ডাক্তার লাগে? এ হল আমাদের সমাজের ছবি। বড় হলে বুঝবি।
সত্যিই শশী বোঝে নি। শুধু এতদিনে এটুকু বুঝেছে বাবার একটা অন্য ভাষা আছে। আর সেটা সবাই বুঝতে পারে না। তাই তো বিক্রি হয় না! বাবার তৈরি দুটো মূর্তিই অন্যসব মূর্তিগুলোর থেকে এতো আলাদা, শশীরই মাঝে মধ্যে অবাক লাগে, বাবা এরকম সব অদ্ভুত ধরণের টেরাকোটার মূর্তি করে কেন। আর তাও আবার এতো কষ্ট করে। মা রোদে মূর্তি শুকোতে দিলেও বাবা ঠিক এসে বারবার দেখে যাবে, আর সময় অনুযায়ী সরিয়ে সরিয়ে রাখবে। মূর্তিটাকে নানান দিক দিয়ে দেখবে। আর বারবার ছোটছোট পরিবর্তন করবে।
শশীর চোখটা যেন একটু ঝাপসা হয়ে উঠল। পিছনের দোকান থেকে কচুরির গন্ধ আসছে। যেদিন মূর্তিটা বিক্রি হবে, এক ঠোঙা কচুরি ও কিনবেই। ওর জন্য, বোনের জন্য, সবার জন্য।
বাড়ীর ভাড়া নিতে আজকে দীপুকাকু আসবে। দীপুকাকু এমনি লোক ভালো। কিন্তু আগের দুবারেই বলে গিয়েছিল – আর ভাড়া না দিলে চলবে না।আমারও তো সংসার আছে, তাই না!
দীপুকাকু না বললেও বাবা যে আর ভাড়া না দিয়ে ও বাড়ীতে থাকবে না, তা শশী জানে। বাবার আত্মসন্মানবোধ খুব বেশী। আগের বারে ভাড়া দেওয়ার সময় বাবা খুব প্রিয় দামী পেনটা বিক্রি করে দিয়েছিল। পেনটা ঠাকুর্দার ছিল।
রোজ সকালে একবার করে পেনটা হাতে নিয়ে বাবা কাগজের উপরে কিসব লিখত খানিকক্ষণ ধরে। জিজ্ঞেস করলে বলত- এটা আমার বাবার ছিল বুঝলি। এটা দিয়েই বাবা সব কবিতা লিখত। হাত রাখলে এখনও মনে হয় বাবার আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে আছি।
তা সে পেনটাও বিক্রি করে দিতে হল। দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরে বাবা অনেকক্ষণ কিছু কথা বলছিল না।
শশীই তখন সান্ত্বনা দিয়েছিল। - মন খারাপ করো না বাবা, আমি বড় হয়ে ওই পেনটাই কিনে দেবো তোমায়।
বাবা কোন উত্তর দেয় নি। কিন্তু শশী কথাটা হাল্কা ভাবে বলে নি। ঠিক, কোন না কোন দিন ফিরিয়ে আনবেই পেনটাকে।
এই যে রাজীব কাকুর দোকানে বাবা আসে না, ওদের পাঠায়, তারও একই কারণ। বাবা অপমান সহ্য করতে পারে না।
তা এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শশীর চোখ পড়ল আবার উলটো দিকের রাজীব কাকুর দোকানে ।
দোকানটাতে একটা বিদেশীদের বড় গ্রুপ ঢুকছে। ওরা যদি কেনে। কিন্তু না। বেশ খানিকক্ষণ পরে ওরা যখন বেরিয়ে এলো, তখনও শশী দেখতে পেল বাবার টেরাকোটার মূর্তি দুটো ওখানে ঠিক একই ভাবে রাখা আছে। হয়ত রাজীব কাকু ঠিকই বলে। বাবার কাজ ভালো না। তবে বাবা যে এত যত্ন নিয়ে কাজ করে, তার কি কোন দাম নেই!
বাবা যে কাজটা করে, সেটা যাতে আরও ভালো করে হয়, তা নিয়ে শশী বাবাকে একবার বলেছিল। পাশ থেকে মার বকা খেয়েছিল তার জন্য।
বাবা কিন্তু রাগে নি। মুচকি হেসে বলেছিল – বুঝলি রে পটাই, এবারেরটা একেবারে মাস্টারপিস হবে।
ওকে ওর বাবা পটাই বলে ডাকে। আদরের ডাক।
-মাস্টারপিস কি বাবা?
বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল, তার পরে বলে উঠেছিল – যেটা ঠিক বিক্রি হয়ে যাবে। আর কিছু দিনের জন্য অন্তত তোদের খাওয়া- দাওয়ার কোন অসুবিধে হবে না।
বলে আবার মূর্তি গড়ায় হাত লাগিয়েছিল বাবা।
সে কাজটা আজকেও চলছে। আরও কিছু দিন লাগবে শেষ করতে। বাড়ী ছাড়লে কি করে কাজটা শেষ হবে কে জানে?
-দাদা, বাড়ী যাবে? – রুনুর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল শশী। সকাল থেকে প্রায় না খেয়েই আছে রুনু। ওর কতই বা বয়স? সাতে পড়ল। তবু দুজনে মাঝে মধ্যে ভারী মূর্তি ধরে আনলে সুবিধে হয়, বলে ওকে নিয়ে আসা। আজকে অবশ্য মূর্তি নেই ওদের সঙ্গে। তবু রুনু কে সঙ্গে নিয়ে আসলে কিরকম যেন একটু সাহসী লাগে।
-চল, যাওয়া যাক রুনু।
-বাবাকে কি বলবে দাদা?
-কি আর বলব? বলব মূর্তি এখনও বিক্রি হয় নি। - বলেই থামল শশী।
এটা এখন কিভাবে বলা যায় ভাবতে হবে। আসলে রোজ রোজ মূর্তি বিক্রি হয় নি বলতে ভালো লাগে না শশীর। শুনলেই বাবার মুখটা কিরকম শুকিয়ে যায়। ঠিক তেমনই মারও। বাবা বোধহয় আরও বেশী আঘাত পায়, তার শিল্পকাজের কোন কদর নেই ভেবে।
তাই খুশী করতেই বাবাকে কাল মিথ্যে কথাটা বলেছিল শশী। বিক্রি হয়ে গেছে। আর দিন দুয়েকের মধ্যেই টাকাটা দিয়ে দেবে রাজীব কাকু। কিন্তু এখন ও কিভাবে আসল কথাটা বলবে যে মূর্তিটা এখনও বিক্রি হয় নি!
-বুঝলি বলে দেবো যে কিনেছিল, সেই আবার ফেরত দিয়ে গেছে। ব্যাস তাহলে ই হবে!
বলতে গিয়েই এতোটা খারাপ লাগল শশীর যে ও মুহূর্তে বুঝল এটা ও বাবাকে কোনভাবে বলতে পারবে না।
কি বলবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওর চোখ পড়ল দোকানের নতুন আগন্তুকের দিকে। বয়স্ক লোক। মুখে চোখে কিরকম যেন রাগ রাগ ভাব। ভুরু কুঁচকে তাকায়। নাকের উপরে ভারী কালো চশমা। এই লোকটা মাঝে-মধ্যেই দোকানে আসে। আর কিছু কিনেও নিয়ে যায়। কালকে ওর বাবার তৈরি মূর্তিটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল।
একটু আশা করে পাশে এগিয়ে গিয়ে শশী বলে উঠেছিল – এটা আমার বাবার করা। নেবেন?
লোকটা কোন কথা বলে নি। চুপ করে আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিটার সামনে। কিন্তু শেষে কেনে নি।
লোকটার গায়ে দামী পাঞ্জাবী, হাতে দামী ঘড়ি। রঙ করা চুল। পায়ে শৌখিন চটি। শশীর মনে হচ্ছিল বলে ওঠে – এটা কিনেই নিন না! কতই বা টাকার ব্যাপার আপনার কাছে। অন্তত আমরা একটা দিনের জন্য আনন্দে থাকি।
কিন্তু শেষে বলতে পারে নি।
আজকেও শশী দূর থেকে লক্ষ্য করল। লোকটা আবার বাবার তৈরি দুটো মূর্তি অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে রেখে দিল। নিজের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস পড়ল শশীর।আর দেরী না করে রুনুর হাত ধরে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেল।
রাত বাড়ছে। হ্যারিকেনের আলোয় মূর্তি তৈরির কাজ এখনও চলছে। একটা কাঠের টেবিলের উপরে মূর্তিটা রেখে শশীর বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পাশে টেবিলের উপরে টুল বক্স রাখা। তাতে ব্রাশ, ক্যালিপার, আলুমিনিয়ামের তার, স্টীলের তার, কাঠের ছুরি, একটা গোল পাথর – আরও অনেক কিছু রাখা। মূর্তি তৈরির জন্য বেশ কিছু যন্ত্র শশীর বাবা নিজের হাতেই তৈরি করেছে। আর সময় পেলেই তা নেড়েচেড়ে দেখে।
আজকের এই মূর্তিতে বেশ কিছু সেনা সারি করে যুদ্ধের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে বই। মুখে বিভ্রান্তির ছাপ। শশীর বাবা মগ্ন হয়ে সেনাদের চোখে ব্রাশ বোলাচ্ছে।
হঠাৎ বাইরে দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনে চমকে উঠল ওরা। নির্ঘাত দীপুকাকু ভাড়া নিতে এসেছে। বাবার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আবার ধাক্কা।
আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল শশীর বাবা। শশীর মা ঘরের ভিতরের দিকে রান্না করছিল। রান্না ছেড়ে শশীর মাও এগিয়ে এলো।
বাবার পিছনে পিছনে শশী এগিয়ে গেল। কিন্তু দরজা খুলতেই ওরা অবাক। দীপুকাকু নয়। শশীর চেনা সকালের সেই বুড়োটা।
বুড়োটা ঘরের মধ্যে ঢুকে বাবার হাতে একটা ছোট ভিজিটিং কার্ড তুলে দিল।
বাবা কার্ডটা দেখে অবাক হয়ে বলে উঠল – রামকিঙ্কর বল! আপনার মতো এতো বড় শিল্পী আমার বাড়ীতে। কি সৌভাগ্য! আমি আপনার কাজের খুব বড় ভক্ত। বসুন বসুন।
বলে ঘরের একমাত্র অক্ষত কাঠের চেয়ারটাকে এগিয়ে দিল।
রামকিঙ্করবাবু চেয়ারে বসে বলে উঠল -বেশীক্ষণ বসব না। তোমার বাড়ী খুঁজে পেতেই অনেক সময় লেগে গেল। আবার কলকাতায় ফিরতে হবে। তা আমার সাম্প্রতিক কাজগুলো দেখেছেো?
-না, আমার তো কলকাতা অতো যাওয়া হয় না। কয়েকবছর আগে একবার আপনার কাজ দেখতে কলকাতায় একটা একজিবিশনে গিয়েছিলাম। কি অসাধারণ সব কাজ।
মুচকি হেসে উঠল রামকিঙ্করবাবু। এই প্রথম হাসতে দেখল শশী। তারপরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রঙ্গীন কাগজ শশীর বাবার হাতে দিয়ে বলে উঠল- এই মূর্তিগুলো চিনতে পারছ?
কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে শশীর বাবা বলে উঠল- কি আশ্চর্য! আমিও একই ধরণের কাজ করেছি। এতো সুন্দর নয় অবশ্য।
-এ তোমারই কাজ বলতে পার!আর আমার দিক দিয়ে চুরিই বলতে পারো। আমি কয়েকবছর আগে এখানে বেড়াতে এসে প্রথম তোমার কাজ দেখি। তখন আমার ভালো সময় যাচ্ছিল না। হঠাৎ করে যেন কিছুদিন নতুন কোন কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোমার কাজ দেখে শুধু মুগ্ধই হই নি, ফের নতুন ভাবে সব কাজ শুরু করতে ইচ্ছে হয়েছিল। আর তখন থেকেই যখনই তুমি কোন কাজ করেছ, আমি তার থেকে আইডিয়া নিয়েছি। তোমার মূর্তি এখানে বিক্রি হয় নি, আর আমার মূর্তি কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। দুটোর মধ্যে কি তফাৎ জানো? – বলে আবার আঙ্গুল তুলে বাবার হাতে রাখা ভিজিটিং কার্ডটা দেখিয়ে বলে উঠল- ওটা। আমার পরিচয়।
-কি – কিন্তু। আমার মূর্তি তো বিক্রিই হয় না!
-এবার থেকে হবে। আমি চাই আমার সঙ্গে তোমার মূর্তিও একই একজিবিশনে থাকুক। বলতে পারো ওটাই হবে আমার গুরুদক্ষিণা।- বলে একটু থেমে ফের বলে উঠল – আগেই করতে পারতাম। কিন্তু ভয় পেতাম। মনে হত এতো অভাব আছে বলেই হয়ত এতো সুন্দর কাজ কর তুমি। তোমার মূর্তিতে এতো আবেগ, এতো গভীরতা, এতো নতুনত্ব। তাই দুটো বাচ্চা উঠতে গিয়েও রুগ্ন ঘোড়ায় উঠতে পারে না। আর ঘোড়ার সঙ্গে কোথায় যেন তুমি মিলে যাও। আমি আগে তোমাকেও জানাতে চাই নি।
- আপনি আমায় লজ্জায় ফেলছেন। আমি আপনার ছাত্র হওয়ারও যোগ্য নই। আপনার মতো শিল্পী আমার কাজের মধ্যে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন, এটাই যথেষ্ট আমার কাছে।
-তা দেখি, এখন তুমি কোন মূর্তি তৈরি করছ?
শশীর বাবা টেবিলের দিকে দেখাতে রামকিঙ্করবাবু উঠে ওদিকে এগিয়ে গেল।
এগিয়ে এসে নতুন মূর্তিটা খানিকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখে বলে উঠল- এটাই মনে হয় আমার দেখা তোমার সেরা কাজ।ঠিকই বুঝেছিলাম। আর তাই আগের দুটো এতোদিন কিনি নি। আমি চাইছিলাম তোমার সেরা মূর্তিটা তুমি তৈরি করো। ভুল আশা করি নি। অসাধারণ। অভাব না থাকলে কি আর এরকম সৃষ্টি সম্ভব?
বলে পকেট থেকে একটা চেক এগিয়ে দিল শশীর বাবার হাতে। - কোন টাকা দিয়ে এ মূর্তি কেনা যায় না। আর আমি কিনবও না। এটা স্থান পাবে আমার সামনের একজিবিশনে। এক মাস পরে। তার মধ্যে যেন এ কাজ শেষ হয় দেখো। তুমিও যাবে। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেবো আগামি দিনের এক সেরা শিল্প প্রতিভার সঙ্গে। শুধু কিছু টাকা আগে থেকে দিয়ে গেলাম, যাতে তোমাদের কয়েক বছরের বাড়ী ভাড়া নিয়ে চিন্তা না করতে হয়!- বলে শশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল- কি খোকা খুশী তো?
শশী ঘাড় ঘুরিয়ে আবার মূর্তিটাকে দেখল। সেনাগুলো যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যুদ্ধের ভঙ্গীতে নয়। হাসি মুখে।

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

গল্প শেষ চিঠি

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
শেষ চিঠি
আমি মাটিতে ধূলোর মধ্যে উবু হয়ে বসে অবাক হয়ে পড়ছিলাম হাতে ধরা চিঠিদুটো। একবার নয়, দুবার পড়লাম। ছবির মতো হাতের লেখা। এসব চিঠির কথাও যেমন ভুলে গিয়েছিলাম, তেমনই ভুলে গিয়েছিলাম তার প্রেরকের কথা। আজ আবার করে সব কথা মনে পড়ে গেল।
আমাদের পুরোনো বাড়ী বিক্রি হয়ে যাবে। তাই দরকারি কোন কিছু পড়ে আছে কিনা সেটাই দেখতে এসেছিলাম এই বাড়ী। প্রায় কুড়ি বছর আগে আমরা এ বাড়ী ছেড়ে অন্য শহরে চলে যাই। বছরে মাঝে - মধ্যে কয়েকদিনের জন্য বড়জোর আসি। তাও গত দুবছর তা সম্ভব হয় নি। কিন্তু আমার স্কুল- কলেজের সেই দিনগুলো এখনও যেন এ বাড়ীরই জানলা-দরজার মধ্যে আটকে আছে।
শোওয়ার ঘরের কাঁচের আলমারিটা খালি করতে গিয়ে চিঠিগুলো হাতে এলো। পৌলমীর। প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর আগে লেখা এই সব চিঠি। একসময়ে বারবার পড়েছি। মাথার বালিশের তলায় নিয়ে শুয়েছি। আর তাই পড়া আর না পড়া চিঠিগুলো আলাদা করতে সময় লাগল না। শেষ দুটো চিঠি দেখে অবাক হলাম।ও দুটো আমার হাতে আর পৌঁছোয়নি। প্রথমবার পড়লাম। আর পৌঁছোয়নি কেন তা লেখা পড়েই বুঝতে পারলাম।
প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস নাইনে। পরীক্ষা শেষ। যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে মালদা। আমার মাসির বাড়ী। আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ফিরে এসেছিল আমার বাবা। কথা ছিল মালদা স্টেশনে আমার মাসি আর মেসোমশাই এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। তা ওই ট্রেনেই আমার সঙ্গে পৌলমীর প্রথম দেখা। অবশ্য দেখা হয়েছিল সেটা বলাও বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়।
ও ছিল ওর দিদি আর বাবার সঙ্গে। ওদের বাড়ী শিলিগুড়ি। সেখানেই ফিরছিল। আমার সঙ্গে ওর বাবা আর দিদিই সেদিন কথা বলছিল। শুধু শুনেছিলাম পৌলমীও আমার মতো ক্লাস নাইনে পড়ে। কিন্তু আমার আর ওর মধ্যে কয়েকবার চোখাচোখি হলেও কথা আর হয় নি। একা যাচ্ছিলাম। যদি কোন অসুবিধে হয়, তাই আমার কাছ থেকে ওর বাবা কথায় কথায় আমার কলকাতার ঠিকানা নিয়ে রেখেছিলেন।
কলকাতায় ফেরার কিছুদিন বাদে ওর প্রথম চিঠি পেলাম। বলা যায় সেই আমাদের মধ্যে প্রথম কথা শুরু। তখন ফোন সব বাড়ীতে ছিল না। আর তাই চিঠির চল ছিল। ওই চিঠির উত্তরে আমার যে চিঠি গেল সেটা ক্লাসের পড়ার বাইরে আমার লেখা প্রথম চিঠি। খুব চিন্তা হচ্ছিল যে বানান ভূলগুলো জানিয়ে হয়ত পরের চিঠিতে এর উত্তর আসবে! ফিরতি চিঠি এলো পূজোর খবর নিয়ে। নতুন জামা, বই পড়া, পুজোর ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যান- তার বাইরে তেমন কিছুই ছিল না তাতে।আমি আবার লিখলাম।
এভাবেই চলল চিঠির পর চিঠি। তবে আমরা জানতাম এসব চিঠি বড়দের হাত ঘুরেই হয়ত আমাদের কাছে আসবে। তাই খানিকটা বর্ণহীণ শব্দের পোষাকে সাজিয়েই আমাদের লিখতে হত। আর এসবের মধ্যে আমি আর ও দুজনেই স্কুলের গণ্ডি পেরোলাম। আমি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম। আর ও শিলিগুড়ির কাছাকাছি একটা কলেজে ইংরাজি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল।
চিঠি থামল না। প্রতি মাসে অন্তত দুবার। আর একটু একটু করে শব্দগুলোও সাহসী হয়ে উঠল। প্রত্যেকবারই মনে হত আরেকটু লেখার জায়গা পেলে বোধহয় ভালো হত। কত কিছুই তো জানানোর আছে। নতুন কলেজ, নতুন বন্ধু, পড়াশোনার খবর, ভালো লাগার খবর। এমন কি কেউ আছে যাকে মনের সব কথা এতো সহজে খুলে লেখা যায়!
প্রত্যেকটা দিন ঠিক যেভাবে রঙ বদলে আমার কাছে ধরা দিত, ঠিক সেভাবে ওকে খবরটা না পাঠাতে পারলে মন খারাপ হয়ে যেত। আর ওরও তাই। আর তাই ওর শহরের রাস্তা, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, এমন কি ওর পছন্দের খাবার, পোশাক সবই যেন আমার চেনা হয়ে উঠেছিল। এক অচেনা শহরের মানচিত্রে শুধুই ছিল ওর নাম।
এরই মধ্যে একটা চিঠিতে জানলাম ওর বাবা অসুস্থ। ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
কেন যেন তখনও মনে হয় নি এই চিঠির বাইরেও একটা বাস্তব জগৎ আছে। আসলে ওর পরিচয়টাই বোধহয় হারিয়ে গিয়েছিল চিঠির শব্দের মধ্যে। আর তাই ওর বাবা অসুস্থ জেনেও দেখা করার কথাটা মাথায় আসে নি। আকাশ যেমন নীল হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়, ঠিক তেমন ও যেন ধরা দিয়েছিল শুধু চিঠির মধ্যেই পেনের দাগে। ঠিক সময়ে চিঠি না পেলে মনে হত যেন বড় কিছু একটা জীবন থেকে বাদ চলে গেছে।
ওর বাবার অসুস্থতার পর থেকেই ওর কাছ থেকে চিঠি আসা কমে গেল। কয়েক মাস বাদে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। আমার বেশ কিছু চিঠির উত্তর এলো না। আমিও খানিকটা অভিমানেই আর চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলাম। পড়াশোনার চাপও ছিল। তা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এতো চেনামুখের মধ্যে একটা প্রায় না দেখা অচেনা মুখ কোথায় যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। সময়ের পেন্টব্রাশে আবেগ হারিয়ে গেল।
আমি তখন কলেজের তৃতীয় বছরে। সেকেন্ড সেমিস্টার চলছে। সেদিন কলেজ থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তার পরের দিন আবার পরীক্ষা। খাওয়া শেষ করে বই নিয়ে বসতে যাবো, মা একটা বিয়ের খাম বাড়িয়ে দিল- তোর জন্য বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠি। পৌলমীর বিয়ে।
কিরকম লেগেছিল ঠিক বলতে পারব না। শুধু মনে হয়েছিল এর পরে আর চিঠি আসবে তো! খোলা খামের মধ্যে থেকে বিয়ের কার্ডটা বার করলাম। পরের শুক্রবারে। মধ্যমগ্রামে। ওখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। যদ্দুর জানি পৌলমীর পিসি থাকত মধ্যমগ্রামে। তাই ওখানেই হয়ত অনুষ্ঠান করছে ওরা। কলেজ ফেরত মধ্যমগ্রাম পৌঁছোতে অনেক রাত হয়ে যাবে।ঠিক করলাম, তবু যাবো।
বিয়ের দিন সকাল থেকে অঝোর বৃষ্টি। নানান রাস্তায় জল জমে গেছে। তার জন্য বাস পেতে আরও দেরি হল। যখন পৌঁছোলাম অনুষ্ঠানবাড়ী, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। কারুর সঙ্গেই বিশেষ পরিচয় নেই। তাই চুপ করে একটু দূরে গিয়ে বসলাম। শেষে পৌলমীর দিদি আমাকে চিনতে পেরে কাছে ডেকে এনে বসালো।
কাছ থেকে বিয়ের সাজে ওকে দেখলাম। ওকে খুব সুন্দর লাগছিল। কপালে চন্দনের দাগ। বড় লাল সিঁদুরের টিপ। কপালে চুল থেকে নেমে আসা সোনার টিকলি। বড় বড় চোখের পাশ দিয়ে কাজলের টান। পরণে লাল বেনারসী। কই, ও তো কোনদিন লেখে নি যে ওকে এতো সুন্দর দেখতে! হয়ত কিরকম দেখতে তা কখনও আমরা কেউ কাউকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করি নি। শুধু একে অন্যের চোখে চারপাশের পৃথিবীটা দেখে গেছি।
বিয়ের মন্ত্র পড়া হচ্ছে, আর তার মধ্যেই দেখলাম আমার দিকে ও বারবার তাকাচ্ছে। শেষে আমার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হেসে উঠল। যেন কত দিন দেখেছে।
বিয়ের কাজ শেষ হওয়ার খানিকবাদে ও এলো। আমাকে ডেকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে গেল। প্রথমবার ওকে এতো কাছ থেকে দেখলাম। কিন্তু তাকাতেই বুঝলাম লেখা শব্দেরা কত শক্তিশালী। আর তাই ও আমার এত চেনা। ওর হাত নাড়া, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, কথা বলা সব কিছুই যেন আমার আগে থেকে দেখা। ওর কোন কিছুই যেন আমার অজানা নয়।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ও বলে উঠল- কি ওভাবে তাকিয়ে আছ? কিরকম লাগছে সাজটা? সেদিন তো লজ্জায় তাকাওই নি। আজকে যে খুব সাহস হয়েছে!
খুব সুন্দর। - বলতে গিয়ে নিজেই কুণ্ঠিত অনুভব করছিলাম।
ও হেসে বলে উঠল- তোমার এই সবুজ শার্টটা তোমার ছোট মামা আগের বারের পূজোতে দিয়েছিল, তাই না? খুব ভিজে গেছো। দেখো জ্বর না আসে।
-তুমি সেটা মনে রেখেছ?
ও হেসে উঠল।বলে উঠল- অনেক কিছুই তো মনে রেখেছি। আর কেউ তো আমাকে লিখবে না যে ‘জানলার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটায় তোমার ঠোঁটের দাগ দেখতে পাই’। আর কেউ বলবে না যে ‘মনে হয় অভিমানী বৃষ্টি হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে মাটির খোঁজ পাই’। আরও বলি সেসব কথা? সামনা সামনি তো এসব কথা কোনদিন বলতে পারতে না, তাই না?
আমার মুখটা লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠছিল।
এর মধ্যে ঘরে একজন মহিলা ঢুকলেন। দেখে মনে হল ওর পিসি। বলে উঠলেন - কি রে সবাই তোর খোঁজ করছে, চল।
-আমি এক মিনিটে আসছি পিসি। - ও একটু ভারী গলায় বলে উঠল।
ওর পিসি চলে যেতে অস্বস্তি কাটাতে বলে উঠলাম- তোমার তো হাসির গল্প সবথেকে ভালো লাগে। তাই কয়েকটা গল্পের বই নিয়ে– বলতে গিয়ে থেমে গেলাম।
হঠাৎ মনে হল ও আমার খুব কাছে চলে এসেছে। ওর নিঃশ্বাস আমার ঠোঁট ছুয়ে গেল। প্রথমবার মনে হল ওর চোখ কিছু বলতে চায়। আমার হাতটা ধরে ও বলে উঠল -তুমি আমার শেষ চিঠিগুলো পড়েছিলে?
আমি সেদিন না জেনেই পড়েছি বলেছিলাম। আর ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠেছিল। আমার জামার হাতাটা মুঠোয় ধরে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়েছিল। সামলে নিয়ে ও বলেছিল- আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম। পাই নি। বাবার মৃত্যুর পরে আর কেউ অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না।
আজকে জানলাম সে চিঠি আমি পড়ি নি। পাঁচ বছরে যে কথা ও আমাকে বলে নি, সেটাই ও লিখেছিল শেষ দুটো চিঠিতে। আর আমার সামনে এখন সেই চিঠিদুটোই পড়ে আছে। দু যুগ বাদে কে যেন আমাকে বলে উঠছে – তোমাকেই চাই।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

উম্ফুন - কোনরকম রাজনীতি না করে আমাদের সবাইকে বিপন্ন মানুষদের পাশে থাকতে হবে


কত লোক যে আজ বাংলায় গৃহহীন হল কে জানে! এ নিয়ে কোনরকম রাজনীতি না করে, আমাদের সবাইকে বিপন্ন মানুষদের পাশে থাকতে হবে। আগামীদিনে গ্লোবাল ওয়ারমিং – এর জন্য এরকম ক্যাটেগরি ৫ ঝড়ের সংখ্যা আরও বাড়বে। আমাদের তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
শুধু নোংরা রাজনীতি চাই না। বাংলায় রাজনীতি অনেকের জীবিকা হয়ে গেছে, সেটাই সমস্যা। একটা অংশ সুবিধেমতো গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। যে শিল্পী আজ মমতার সোশ্যাল ডিস্টান্সিং- এর ছবি আঁকছে, আর প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিচ্ছে, সেই সময় সুবিধেমতো দেখবেন রঙ বদলে মোদীর ছবি আঁকবে। এখন সব ভুলে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে শুধু সাধারণ মানুষের কাছে যাতে ত্রাণ পৌঁছোয়, সেটাই দেখতে হবে।

আমার ছেলেবেলার পুজো


অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

ছেলেবেলার পুজোর দিনগুলো সত্যি অন্যরকম ছিল। আমি সত্তরের দশক ও আশির দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি। সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম ওই ক’দিনের।  তখন মোবাইল ফোন ছিল  না। ইচ্ছে হলো আর ফোন করে আরেকজনের সঙ্গে কথা বলব, সেরকম উপায় ছিল না। 

তখনকার সোশ্যাল নেটওয়ারকের অর্থ ছিল ওই ক’দিনের নির্ভেজাল আড্ডা। বাড়ীর সব নিয়ন্ত্রণরেখাগুলো যেন ওই কদিনের জন্য শিথিল করে দেওয়া হত। ওই উৎসবের দিনগুলো ছিল আত্মীয়- দূরাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার সময়, নিয়ম ভাঙ্গার দিন। যে যেখানেই থাকুক না কেন ওই সময় ঠিক কলকাতায় চলে আসত।

আমি ছোটবেলা থেকেই খুব কল্পনা প্রবণ ছিলাম। একটা বড় সময় থাকতাম নিজের কল্পনার জগতে যেখান গল্প প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়, কখনও আমাকে নিয়েই হারিয়ে যায়। পুজোর সময়ে সে কল্পনার জগতে আরও রসদ মিলত। সমাজের এমন একটা অংশকে কাছ থেকে দেখতে পারতাম, যাদের সঙ্গে অন্য সময়ে অত সহজে মেশা যেত না।  

আমাদের বাড়ীর প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পুরনো পারিবারিক পুজো হত খুলনার খলসেখালিতে। সেখান থেকে দেশভাগের পরে সেটা চলে আসে হাড়োয়ার হরিপুরে। ছোটবেলায় ওখানে পুজোর সময়ে দুদিন যেতাম। কলকাতা থেকে বাসে করে যেতাম। একদিকেই প্রায় ঘণ্টা তিনেক। কষ্ট হলেও আনন্দ হত বহুগুণ বেশী।

পুজো উপলক্ষে বেশ কয়েকটা গ্রাম মিলিয়ে বেশ বড় মেলা বসত। বেশ বড় মণ্ডপে আটচালার পুজো হত। তার সামনেই কিছু দূরে বসত মেলা। বেলুন, প্লাস্টিকের বন্দুক, আরও কত কি। আমার  পুজোতে কোন আগ্রহ ছিল না। আমার আগ্রহ ছিল মেলায়, পুজোর জন্য যারা আসত গ্রামের সে সব মানুষে। মিশে যেতাম গ্রামের সমবয়সীদের ভিড়ে। 

অনেক সময় মাঠ, খেত- আল পেরিয়ে অনেক দূরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম।
 আমাদের ওখানে পুজোর জন্য একটা পাকা বাড়ী ছিল। সেখানে অবশ্য ছিল শুধু বড়দের আড্ডা। পুজোর সব আয়োজন, খাবার দাবারের ব্যবস্থা সেখান থেকে হত। শুধু খাওয়ার ডাক এলে ওখানে যেতাম। বাকি সময় বাইরেই থাকতাম।

সে পুজো অবশ্য পরে বন্ধ হয়ে যায় কিছু সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের কারণে। ছোট ছিলাম তাই মনের মধ্যে যাতে বিদ্বেষের দেওয়াল না গড়ে ওঠে, সেজন্য কখনও বাবা- মা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে নি। পরে বড় হয়ে জেনেছি। ওখান থেকে পুজো সেই কারণে শ্যামবাজারের বাড়ীতে সরিয়ে আনা হয়।

আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের পারিবারিক অবস্থা বেশ খারাপ হতে শুরু করে। এজন্য আমি নিজেকে আজও ভাগ্যবান মনে করি। হয়ত সেটা না হলে আমি অন্যদের কষ্ট অনুভব করতে শিখতাম না। পুজোর ভিড়ে তাই আমি খুব সহজেই একাত্ম হতে পারতাম তাদের সঙ্গে, যাদের কিছু নেই।  

আমার বাবা বলতেন ঈশ্বরের কাছে কখনও শুধু নিজের ভালো চাইতে নেই।মন থেকে সবার ভালো চাইতে হয়। আমিও তাই চাইতাম। রোজ রোজ নিজের কথা ভুলে সবার জন্য এই চাওয়ার মধ্যে যে কত বড় আনন্দ আছে তখন তা বুঝি নি। আর ওটাই বোধহয় ছিল আমার সবসময়ের আনন্দের অজানা উৎস। নিজের খারাপ লাগা, বেদনা তার পাশে অনেক ছোট হয়ে যেত। একটু একা থাকলেই হারিয়ে যেতাম আমার কল্পনার রাজ্যে, যেখানে মন খারাপের কোন জায়গা নেই।

অনেকে বাইরে থেকে জানত না যে আমাদের ড্রয়িংরুমে ঝাড়বাতির তলায় তখন শুধুই ছায়া, শুধুই অন্ধকার, শুধুই অভাব ঘরের সেই অন্ধকার কোনকে আমি কিন্তু ভয় পেতাম না। শুধু বুঝেছিলাম এই আলো - ছায়া  দুটো মিলেই আমাদের জীবন। দুটোই অনিত্য। অনেক সময় পুজোর সময়েও ওই নির্জনতাই ছিল আমার সঙ্গী, গভীর আত্মোপলব্ধির জায়গা।

আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ী ছিল গোয়াবাগানের পুরনো পাড়ায়। ওই বাড়ী ছিল আমার বাবার মেসোমশাই নলিনীকান্ত ব্রহ্মর। উনি ছিলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের ধর্ম ও দর্শনের বিখ্যাত প্রফেসার। ওঁর লেখা হিন্দুধর্ম ও দর্শনের উপরে বেশ কিছু বিখ্যাত বই আছে। ওঁকে আমি অবশ্য দেখি নি। ওঁদের বাড়ীতেও দুর্গাপুজো হত। 

এখন বুঝতাম কেন বাবা আমাকে ও  দিদিকে ওখানে নিয়ে যেত। সৎসঙ্গ, ভালো পরিবেশ ছোটদের মনের উপরে ভালো প্রভাব ফেলে। সেদিক দিয়ে ওই বাড়ী ছিল সত্যি ভালো অনেক কিছু শেখার ল্যাবরেটরি। যেভাবে সেখানে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা হত, যেভাবে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা হত, যেভাবে প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধের উপরে জোর দেওয়া হত, তার গুরুত্ব তখন না বুঝলেও আজ বুঝি।

ওদের বাড়ীতে পুজো ওরা নিজেরাই করত। পুজোর প্রত্যেকটা আচার, রীতিনীতি সব কিছুই নিখুঁতভাবে পালন করা হত। ওই পুজো উপলক্ষে পরিবারের লতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা অনেক দূরাত্মীয় দেশ-বিদেশ থেকে আসত। আগে থেকে না চিনলেও, মুহূর্তের আলাপে আমরা সবাই যেন খুব বন্ধু হয়ে যেতাম। ঠিক আমার বাবা- মার মতোই ওখানে কখনও কাউকে কারুর সম্বন্ধে নেগেটিভ কথা বলতে শুনি নি। খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল ও বাড়ীতে। 

ওই বাড়ীতে আমার এক খুব প্রিয় বড়দিদি ছিল যে আমাদের সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেত। আমাদের সবাইকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্প শোনাত।শক্ত শক্ত ধাঁধা দিত। পুজোর থেকে সেটাই ছিল বড় আকর্ষণ।  

আমরা সবাই মিলে হইচই করে এমন ভাবে কাটাতাম যে পুজোর শেষে মন খারাপ হয়ে যেত। মনে হত আবার কবে ওদের সঙ্গে দেখা হবে।

আগেই বলেছি যে আমাদের সেই সময় অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তাই পুজোতে নতুন জামা, জুতো এসব তেমন হত না। অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবার ও সময় পেতাম না। কোন রকম ক্ষোভও ছিল না।

আমাদের নিজেদের বাড়ী ছিল উত্তর কলকাতায় রামতনু বোস লেনে। চারদিকে পুজোর প্যান্ডেল। পরপর বেশ কয়েকটা নামকরা পুজো। বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, সিমলা ব্যায়াম সমিতি। ওই ক’দিন লোকের ভিড়ে যেন চেনা রাস্তাই অচেনা হয়ে যেত। আমার  ভালো লাগত ভিড়ের থেকে দূরে খানিকটা একা একা সময় কাটাতে। লক্ষ্য করতাম যাদের কিছু নেই, তাদের মধ্যেও যেন কিভাবে ওই আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। ফুটপাতে বসেও তারা যেন পুজোর আনন্দে মেতে আছে। আমার কেন জানি না এটা দেখে খুব ভালো লাগত।   

এসবের বাইরে ছিল সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা। মনে হত যেন সবার সঙ্গে দেখা না হলে পুজোর আনন্দেই যেন কোথায় ফাঁক থেকে গেল। 

এখন সেই পুজোর মধ্যের অন্তরঙ্গ আন্তরিকতাই  যেন সব থেকে বেশী মিস করি। এখানে ইংল্যান্ডে কোন একটা পুজোতে যাই। দেখি সেই আন্তরিকতাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সবাই শুধু পুজোর বাহ্যিক ব্যাপারটাতেই জোর দিচ্ছে। কিন্তু এটা তো মিলনের উৎসব? সেই জায়গাটাই গড়ে ওঠে না যেখানে একজনের সঙ্গে আরেকজনের দূরত্ব কয়েকটা কথাতেই মুছে যাবে।

কে জানে এটা হয়ত শুধু ছেলেবেলাতেই সম্ভব। তখন তো মনের মধ্যে দেওয়াল গড়ে ওঠে নি।  


অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
২-সেপ্টেম্বর-২০১৯

Friday, May 1, 2020