Saturday, May 23, 2020

গল্প মূর্তি

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
মূর্তি

আজকে শশীর মন খুব খারাপ। আজকেও কোন মূর্তি বিক্রি হল না। উল্টে দোকান থেকে রাজীবকাকুর ধমক খেতে হয়েছে।
-রোজ কতবার করে বলব যে তোর বাবার মূর্তি বিক্রি হয় না! আগেরটা বিক্রি হলে, তবে তো আবার নতুন কিনব? বাবাকে বলিস ঘোড়ার মূর্তি তৈরি করতে বা ঠাকুর-দেবতার মূর্তি। দুর্গার- সরস্বতীর – গণেশের মূর্তি তৈরি করতে পারে। তাও কিছু কেনার লোক থাকে। আর সেটাও যদি না পারে, তো থালা বাটি গেলাস- এসব কাজের জিনিষও তো তৈরি করতে পারে! তাও যদি কোনটা বিক্রি হয়!তোর বাবা যে কি সব হাবিজাবি জিনিষ তৈরি করে, তার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝি না। কাস্টমার কিনবে কেন? তাও তো আমি ওগুলো আমার দোকানে রাখি। নগেনের দোকানে গিয়ে দেখ। রাখবেই না।
মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলেছিল শশী – ঠিক আছে কাকু। কালকে আসব। বাবা বলে রোজ আসতে। যদি কাল বিক্রি হয়ে যায়।আর তোমার কাছে যদি বাবার তৈরি কোন মূর্তি না থাকে! যদি কেউ কিনতে এসে ফিরে যায়?
-না না, আর জ্বালাস না। আর আসবি না। দরকার হলে আমিই জানাব। যা বেরিয়ে যা।এতদিন বিক্রি হল না। কালকেই বিক্রি হয়ে যাবে!– চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল রাজীবকাকু।
শশী আর থাকে নি। বোনের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল। তবে বাড়ী ফিরে যায় নি। একটু দূর থেকে দোকানটার উপরে নজর রেখেছিল। যদি কেউ কিনতে আসে। রাজীবকাকুর দোকানটা বেশ বড়। শহরের মূল বাজারের মধ্যে। তাই টুরিস্টদের বড় একটা অংশ এখানে আসে। ওরা তারই উলটো দিকের রাস্তায় খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রইল।
রোদ বাড়ছে। জ্যৈষ্ঠ মাস। তেতে ওঠা রাস্তার তাপ ছেঁড়া চটির ফাঁক দিয়ে পায়ে লাগছে। খিদেও পাচ্ছে। কিন্তু আজকে ওদের একটা মূর্তি বিক্রি করতেই হবে।বাবার দুটো মূর্তি আছে দোকানটাতে। যে কোন একটা বিক্রি হলেই হল।
দূর থেকে এখনও মূর্তি দুটো দেখা যাচ্ছে। একটা ঘোড়ার উপরে দুটো বাচ্চা ওঠার চেষ্টা করছে। আর ঘোড়াটা যেন অসুস্থ। মাটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সাড়ে তিন ফুটের মত লম্বা ঘোড়াটা, আর উচ্চতায় প্রায় দুফুট।বাবা যখন মূর্তিটা তৈরি করছিল, তখন শশী কে ডেকে ডেকে বলতো – বুঝলি যাদের কথা আমরা বুঝি না, তাদের কথাও বোঝা যায় তাদের খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে। কানের দিকটা লক্ষ্য কর।তাকানোটা লক্ষ্য কর। ঘাড়ের দিকটা লক্ষ্য কর। সামান্য ঢেউ খেলান ভাবটা দেখেছিস।- বলে আবার ঘোড়াটার গলার উপরে হাত বোলাত, আবার মাটির প্রলেপ দিত।
তিন ঘণ্টা বাদেও শশী দেখত, বাবা তখনও ঘোড়ার উপরেই কাজ করে যাচ্ছে।
অন্য মূর্তিটা বোঝা আরও শক্ত। তিনটে লোক তিন ধরণের পোষাকে একটা শুয়ে থাকা অসুস্থ লোককে ঘিরে বসে আছে। আর আঙুল তুলে নিজেদের মধ্যে তর্ক করে যাচ্ছে। শুয়ে থাকা লোকটা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাবার কথা মনে পড়ল শশীর- শুয়ে থাকা লোকটার মুখটা খেয়াল কর। একদিকে যন্ত্রণা ,অন্যদিকে চারদিকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-তা বাবা ওরা ডাক্তার ডাকে নি কেন?
-সব চিকিৎসায় কি আর ডাক্তার লাগে? এ হল আমাদের সমাজের ছবি। বড় হলে বুঝবি।
সত্যিই শশী বোঝে নি। শুধু এতদিনে এটুকু বুঝেছে বাবার একটা অন্য ভাষা আছে। আর সেটা সবাই বুঝতে পারে না। তাই তো বিক্রি হয় না! বাবার তৈরি দুটো মূর্তিই অন্যসব মূর্তিগুলোর থেকে এতো আলাদা, শশীরই মাঝে মধ্যে অবাক লাগে, বাবা এরকম সব অদ্ভুত ধরণের টেরাকোটার মূর্তি করে কেন। আর তাও আবার এতো কষ্ট করে। মা রোদে মূর্তি শুকোতে দিলেও বাবা ঠিক এসে বারবার দেখে যাবে, আর সময় অনুযায়ী সরিয়ে সরিয়ে রাখবে। মূর্তিটাকে নানান দিক দিয়ে দেখবে। আর বারবার ছোটছোট পরিবর্তন করবে।
শশীর চোখটা যেন একটু ঝাপসা হয়ে উঠল। পিছনের দোকান থেকে কচুরির গন্ধ আসছে। যেদিন মূর্তিটা বিক্রি হবে, এক ঠোঙা কচুরি ও কিনবেই। ওর জন্য, বোনের জন্য, সবার জন্য।
বাড়ীর ভাড়া নিতে আজকে দীপুকাকু আসবে। দীপুকাকু এমনি লোক ভালো। কিন্তু আগের দুবারেই বলে গিয়েছিল – আর ভাড়া না দিলে চলবে না।আমারও তো সংসার আছে, তাই না!
দীপুকাকু না বললেও বাবা যে আর ভাড়া না দিয়ে ও বাড়ীতে থাকবে না, তা শশী জানে। বাবার আত্মসন্মানবোধ খুব বেশী। আগের বারে ভাড়া দেওয়ার সময় বাবা খুব প্রিয় দামী পেনটা বিক্রি করে দিয়েছিল। পেনটা ঠাকুর্দার ছিল।
রোজ সকালে একবার করে পেনটা হাতে নিয়ে বাবা কাগজের উপরে কিসব লিখত খানিকক্ষণ ধরে। জিজ্ঞেস করলে বলত- এটা আমার বাবার ছিল বুঝলি। এটা দিয়েই বাবা সব কবিতা লিখত। হাত রাখলে এখনও মনে হয় বাবার আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে আছি।
তা সে পেনটাও বিক্রি করে দিতে হল। দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরে বাবা অনেকক্ষণ কিছু কথা বলছিল না।
শশীই তখন সান্ত্বনা দিয়েছিল। - মন খারাপ করো না বাবা, আমি বড় হয়ে ওই পেনটাই কিনে দেবো তোমায়।
বাবা কোন উত্তর দেয় নি। কিন্তু শশী কথাটা হাল্কা ভাবে বলে নি। ঠিক, কোন না কোন দিন ফিরিয়ে আনবেই পেনটাকে।
এই যে রাজীব কাকুর দোকানে বাবা আসে না, ওদের পাঠায়, তারও একই কারণ। বাবা অপমান সহ্য করতে পারে না।
তা এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শশীর চোখ পড়ল আবার উলটো দিকের রাজীব কাকুর দোকানে ।
দোকানটাতে একটা বিদেশীদের বড় গ্রুপ ঢুকছে। ওরা যদি কেনে। কিন্তু না। বেশ খানিকক্ষণ পরে ওরা যখন বেরিয়ে এলো, তখনও শশী দেখতে পেল বাবার টেরাকোটার মূর্তি দুটো ওখানে ঠিক একই ভাবে রাখা আছে। হয়ত রাজীব কাকু ঠিকই বলে। বাবার কাজ ভালো না। তবে বাবা যে এত যত্ন নিয়ে কাজ করে, তার কি কোন দাম নেই!
বাবা যে কাজটা করে, সেটা যাতে আরও ভালো করে হয়, তা নিয়ে শশী বাবাকে একবার বলেছিল। পাশ থেকে মার বকা খেয়েছিল তার জন্য।
বাবা কিন্তু রাগে নি। মুচকি হেসে বলেছিল – বুঝলি রে পটাই, এবারেরটা একেবারে মাস্টারপিস হবে।
ওকে ওর বাবা পটাই বলে ডাকে। আদরের ডাক।
-মাস্টারপিস কি বাবা?
বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল, তার পরে বলে উঠেছিল – যেটা ঠিক বিক্রি হয়ে যাবে। আর কিছু দিনের জন্য অন্তত তোদের খাওয়া- দাওয়ার কোন অসুবিধে হবে না।
বলে আবার মূর্তি গড়ায় হাত লাগিয়েছিল বাবা।
সে কাজটা আজকেও চলছে। আরও কিছু দিন লাগবে শেষ করতে। বাড়ী ছাড়লে কি করে কাজটা শেষ হবে কে জানে?
-দাদা, বাড়ী যাবে? – রুনুর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল শশী। সকাল থেকে প্রায় না খেয়েই আছে রুনু। ওর কতই বা বয়স? সাতে পড়ল। তবু দুজনে মাঝে মধ্যে ভারী মূর্তি ধরে আনলে সুবিধে হয়, বলে ওকে নিয়ে আসা। আজকে অবশ্য মূর্তি নেই ওদের সঙ্গে। তবু রুনু কে সঙ্গে নিয়ে আসলে কিরকম যেন একটু সাহসী লাগে।
-চল, যাওয়া যাক রুনু।
-বাবাকে কি বলবে দাদা?
-কি আর বলব? বলব মূর্তি এখনও বিক্রি হয় নি। - বলেই থামল শশী।
এটা এখন কিভাবে বলা যায় ভাবতে হবে। আসলে রোজ রোজ মূর্তি বিক্রি হয় নি বলতে ভালো লাগে না শশীর। শুনলেই বাবার মুখটা কিরকম শুকিয়ে যায়। ঠিক তেমনই মারও। বাবা বোধহয় আরও বেশী আঘাত পায়, তার শিল্পকাজের কোন কদর নেই ভেবে।
তাই খুশী করতেই বাবাকে কাল মিথ্যে কথাটা বলেছিল শশী। বিক্রি হয়ে গেছে। আর দিন দুয়েকের মধ্যেই টাকাটা দিয়ে দেবে রাজীব কাকু। কিন্তু এখন ও কিভাবে আসল কথাটা বলবে যে মূর্তিটা এখনও বিক্রি হয় নি!
-বুঝলি বলে দেবো যে কিনেছিল, সেই আবার ফেরত দিয়ে গেছে। ব্যাস তাহলে ই হবে!
বলতে গিয়েই এতোটা খারাপ লাগল শশীর যে ও মুহূর্তে বুঝল এটা ও বাবাকে কোনভাবে বলতে পারবে না।
কি বলবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওর চোখ পড়ল দোকানের নতুন আগন্তুকের দিকে। বয়স্ক লোক। মুখে চোখে কিরকম যেন রাগ রাগ ভাব। ভুরু কুঁচকে তাকায়। নাকের উপরে ভারী কালো চশমা। এই লোকটা মাঝে-মধ্যেই দোকানে আসে। আর কিছু কিনেও নিয়ে যায়। কালকে ওর বাবার তৈরি মূর্তিটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল।
একটু আশা করে পাশে এগিয়ে গিয়ে শশী বলে উঠেছিল – এটা আমার বাবার করা। নেবেন?
লোকটা কোন কথা বলে নি। চুপ করে আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিটার সামনে। কিন্তু শেষে কেনে নি।
লোকটার গায়ে দামী পাঞ্জাবী, হাতে দামী ঘড়ি। রঙ করা চুল। পায়ে শৌখিন চটি। শশীর মনে হচ্ছিল বলে ওঠে – এটা কিনেই নিন না! কতই বা টাকার ব্যাপার আপনার কাছে। অন্তত আমরা একটা দিনের জন্য আনন্দে থাকি।
কিন্তু শেষে বলতে পারে নি।
আজকেও শশী দূর থেকে লক্ষ্য করল। লোকটা আবার বাবার তৈরি দুটো মূর্তি অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে রেখে দিল। নিজের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস পড়ল শশীর।আর দেরী না করে রুনুর হাত ধরে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেল।
রাত বাড়ছে। হ্যারিকেনের আলোয় মূর্তি তৈরির কাজ এখনও চলছে। একটা কাঠের টেবিলের উপরে মূর্তিটা রেখে শশীর বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পাশে টেবিলের উপরে টুল বক্স রাখা। তাতে ব্রাশ, ক্যালিপার, আলুমিনিয়ামের তার, স্টীলের তার, কাঠের ছুরি, একটা গোল পাথর – আরও অনেক কিছু রাখা। মূর্তি তৈরির জন্য বেশ কিছু যন্ত্র শশীর বাবা নিজের হাতেই তৈরি করেছে। আর সময় পেলেই তা নেড়েচেড়ে দেখে।
আজকের এই মূর্তিতে বেশ কিছু সেনা সারি করে যুদ্ধের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে বই। মুখে বিভ্রান্তির ছাপ। শশীর বাবা মগ্ন হয়ে সেনাদের চোখে ব্রাশ বোলাচ্ছে।
হঠাৎ বাইরে দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনে চমকে উঠল ওরা। নির্ঘাত দীপুকাকু ভাড়া নিতে এসেছে। বাবার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আবার ধাক্কা।
আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল শশীর বাবা। শশীর মা ঘরের ভিতরের দিকে রান্না করছিল। রান্না ছেড়ে শশীর মাও এগিয়ে এলো।
বাবার পিছনে পিছনে শশী এগিয়ে গেল। কিন্তু দরজা খুলতেই ওরা অবাক। দীপুকাকু নয়। শশীর চেনা সকালের সেই বুড়োটা।
বুড়োটা ঘরের মধ্যে ঢুকে বাবার হাতে একটা ছোট ভিজিটিং কার্ড তুলে দিল।
বাবা কার্ডটা দেখে অবাক হয়ে বলে উঠল – রামকিঙ্কর বল! আপনার মতো এতো বড় শিল্পী আমার বাড়ীতে। কি সৌভাগ্য! আমি আপনার কাজের খুব বড় ভক্ত। বসুন বসুন।
বলে ঘরের একমাত্র অক্ষত কাঠের চেয়ারটাকে এগিয়ে দিল।
রামকিঙ্করবাবু চেয়ারে বসে বলে উঠল -বেশীক্ষণ বসব না। তোমার বাড়ী খুঁজে পেতেই অনেক সময় লেগে গেল। আবার কলকাতায় ফিরতে হবে। তা আমার সাম্প্রতিক কাজগুলো দেখেছেো?
-না, আমার তো কলকাতা অতো যাওয়া হয় না। কয়েকবছর আগে একবার আপনার কাজ দেখতে কলকাতায় একটা একজিবিশনে গিয়েছিলাম। কি অসাধারণ সব কাজ।
মুচকি হেসে উঠল রামকিঙ্করবাবু। এই প্রথম হাসতে দেখল শশী। তারপরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রঙ্গীন কাগজ শশীর বাবার হাতে দিয়ে বলে উঠল- এই মূর্তিগুলো চিনতে পারছ?
কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে শশীর বাবা বলে উঠল- কি আশ্চর্য! আমিও একই ধরণের কাজ করেছি। এতো সুন্দর নয় অবশ্য।
-এ তোমারই কাজ বলতে পার!আর আমার দিক দিয়ে চুরিই বলতে পারো। আমি কয়েকবছর আগে এখানে বেড়াতে এসে প্রথম তোমার কাজ দেখি। তখন আমার ভালো সময় যাচ্ছিল না। হঠাৎ করে যেন কিছুদিন নতুন কোন কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোমার কাজ দেখে শুধু মুগ্ধই হই নি, ফের নতুন ভাবে সব কাজ শুরু করতে ইচ্ছে হয়েছিল। আর তখন থেকেই যখনই তুমি কোন কাজ করেছ, আমি তার থেকে আইডিয়া নিয়েছি। তোমার মূর্তি এখানে বিক্রি হয় নি, আর আমার মূর্তি কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। দুটোর মধ্যে কি তফাৎ জানো? – বলে আবার আঙ্গুল তুলে বাবার হাতে রাখা ভিজিটিং কার্ডটা দেখিয়ে বলে উঠল- ওটা। আমার পরিচয়।
-কি – কিন্তু। আমার মূর্তি তো বিক্রিই হয় না!
-এবার থেকে হবে। আমি চাই আমার সঙ্গে তোমার মূর্তিও একই একজিবিশনে থাকুক। বলতে পারো ওটাই হবে আমার গুরুদক্ষিণা।- বলে একটু থেমে ফের বলে উঠল – আগেই করতে পারতাম। কিন্তু ভয় পেতাম। মনে হত এতো অভাব আছে বলেই হয়ত এতো সুন্দর কাজ কর তুমি। তোমার মূর্তিতে এতো আবেগ, এতো গভীরতা, এতো নতুনত্ব। তাই দুটো বাচ্চা উঠতে গিয়েও রুগ্ন ঘোড়ায় উঠতে পারে না। আর ঘোড়ার সঙ্গে কোথায় যেন তুমি মিলে যাও। আমি আগে তোমাকেও জানাতে চাই নি।
- আপনি আমায় লজ্জায় ফেলছেন। আমি আপনার ছাত্র হওয়ারও যোগ্য নই। আপনার মতো শিল্পী আমার কাজের মধ্যে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন, এটাই যথেষ্ট আমার কাছে।
-তা দেখি, এখন তুমি কোন মূর্তি তৈরি করছ?
শশীর বাবা টেবিলের দিকে দেখাতে রামকিঙ্করবাবু উঠে ওদিকে এগিয়ে গেল।
এগিয়ে এসে নতুন মূর্তিটা খানিকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখে বলে উঠল- এটাই মনে হয় আমার দেখা তোমার সেরা কাজ।ঠিকই বুঝেছিলাম। আর তাই আগের দুটো এতোদিন কিনি নি। আমি চাইছিলাম তোমার সেরা মূর্তিটা তুমি তৈরি করো। ভুল আশা করি নি। অসাধারণ। অভাব না থাকলে কি আর এরকম সৃষ্টি সম্ভব?
বলে পকেট থেকে একটা চেক এগিয়ে দিল শশীর বাবার হাতে। - কোন টাকা দিয়ে এ মূর্তি কেনা যায় না। আর আমি কিনবও না। এটা স্থান পাবে আমার সামনের একজিবিশনে। এক মাস পরে। তার মধ্যে যেন এ কাজ শেষ হয় দেখো। তুমিও যাবে। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেবো আগামি দিনের এক সেরা শিল্প প্রতিভার সঙ্গে। শুধু কিছু টাকা আগে থেকে দিয়ে গেলাম, যাতে তোমাদের কয়েক বছরের বাড়ী ভাড়া নিয়ে চিন্তা না করতে হয়!- বলে শশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল- কি খোকা খুশী তো?
শশী ঘাড় ঘুরিয়ে আবার মূর্তিটাকে দেখল। সেনাগুলো যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যুদ্ধের ভঙ্গীতে নয়। হাসি মুখে।

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

4 comments:

  1. উফঃ দাদা... মন ছুঁয়ে গেল! মূর্তি গুলোর মতোই মাস্টারপিস গল্প। 🙏

    ReplyDelete
  2. এই গল্পটা আগেও পড়েছিলাম অভিজ্ঞানদা, আপনার লেখা সেরা ৫ টি গল্পের মধ্যে আসবেই। এটা আমার খুব পছন্দের গল্প।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যা, আমারও খুব প্রিয় গল্প। তবে অন্য গল্পের সঙ্গে তুলনা করা শক্ত, কারণ আমার প্রত্যেকটা গল্প তার চরিত্রে স্বতন্ত্র। আমি এটা অবশ্যই আমার সবথেকে প্রিয় কুড়িটা গল্পের মধ্যে রাখব।

      Delete
  3. অসাধারণ লাগলো গল্পটা, মাস্টারপীস গল্প। সেরার সেরা।

    ReplyDelete