Friday, June 18, 2021

সেই ছেলেটা যে কোনদিনই ছিল না

 অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

সেই ছেলেটা যে কোনদিনই ছিল না
আমার ঠিক সামনেই সেই ছেলেটা যে নাকি কোনদিনই ছিল না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সামনের স্মৃতিফলকের দিকে। এও কী সম্ভব?
ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরের ওয়ার মেমোরিয়াল পার্ক। রোদ ঝলমলে দিন। তাই এই পার্কে খানিকক্ষণের জন্যে বেড়াতে এসেছি। বাড়ীর কাছেই। সেজন্যই হয়ত এখানে আগে আসা হয় নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গেছে, তাদের স্মৃতিতে শহরের মাঝেই এই সুবিশাল পার্ক। এছাড়া পার্কের মধ্যে খুব বড় একটা মেমোরিয়াল স্তম্ভ আছে।
বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের প্রত্যেকের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এক একটা গাছ। সেই সৈনিকের নাম লেখা আছে গাছের নিচের স্মৃতিফলকে। বেশীরভাগই খুব কম বয়সে মারা গেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে অকালে ঝরে যাওয়া অনেক অসম্পূর্ণ জীবনের কথা।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে ঘাসের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র হলুদ ড্যাফোডিল ফুল। সবুজের মধ্যে হলুদের ভারী সুন্দর সমাহার। এ দেশে শীতের ঘুম ভাঙ্গার প্রথম লক্ষণ। পাহারাদারের মতো ঘিরে আছে একটা ছোট স্মৃতিফলককে। বলা যায় ড্যাফোডিল ফুলে যেন খানিকটা ঢাকাই পরে গেছে স্মৃতিফলকটা। একটা আড়াই ফুট উঁচু, দেড় ফুট চওড়া পাথরের উপরে লেখা মৃত সৈনিকের নাম।
স্মৃতিফলকের পিছনে একটা পত্রহীন রিক্ত বিশাল বারচ গাছ। যেন ছুটে চলা সময়ের হাত থেকে ফলকটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল গাছটার নিরাভরণ শাখাপ্রশাখার উপর নীল আকাশ নেমে এসেছে।
আমার মনে হচ্ছিল যেন দমবন্ধ হয়ে গেছে। এ কি দেখছি! মনে হচ্ছিল হঠাৎ করে কেউ যেন আমাকে টাইম মেশিনে করে চল্লিশ বছর পিছনে নিয়ে গেছে। আমার সামনেই ঠিক সেই ছবি যা ছোটবেলা থেকে বহুবার দেখেছি। সেই ফ্রেমে বাঁধানো হাতে আঁকা ছবি। কতবার দেখেছি সে সংখ্যা আমার জানা নেই।
একটু আগে থেকে শুরু করি। একটু আগে মানে চল্লিশ বছর আগে থেকে।
সাল ১৯৮০। তখন মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। লোডশেডিং ছিল, রেডিও -তে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল, টিভিতে একমাত্র চ্যানেল ছিল কলকাতা দূরদর্শন। সেই সময়ের কথা।
রায়ান আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল।
ভর্তির কয়েক মাস পরেও স্কুলে রায়ানের একমাত্র বন্ধু ছিলাম আমি। অবশ্য তার যথেষ্ট কারণও ছিল। একে তো ওকে দেখতে একটু সাহেবসুবোদের মতো ছিল, তাছাড়া এতো আস্তে আস্তে কথা বলত যে ওর প্রায় কোন কথাই শোনা যেত না।
হাসি ঠাট্টাতে সহজে যোগ দিত না। মনে হত যেন কিসের একটা ঘোরে হারিয়ে আছে। এমন কি ভবেশবাবুর মতো রাগী টীচার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে যখন আমরা সবাই মিলে পরের ক্লাসের আগে দু তিন মিনিট লাফালাফি করতাম, তখনও দেখতাম ও চুপ করে বসে বসে কী ভাবছে। দেখে মনে হত কোন কথা বলতেই যেন ওর কষ্ট হয়। মনে হত অন্য কোন গ্রহের জীব। ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে।
যদিও ওর আসল নাম ছিল রায়ান, আমরা সবাই ওকে ‘রায়’ বলেই বলতাম। । অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। শুনেছিলাম ওর বাবা ইংরেজ, মা ভারতীয়। দেখেই সেটা বোঝা যেত। চোখের মনির রঙ ছিল অপরাজিত ফুলের মতো নীল। গায়ের রঙ খুব ফরসা না হলেও আমাদের থেকে অনেক পরিষ্কার।
সকালে আমার পাশে এসে বসে শুধু আমাকে বলত- গুড মরনিং। কেমন আছিস?
আমি হয়ত বললাম -ভালো। তুই? কাল ভারত- ইংল্যান্ডের ক্রিকেট টেস্টম্যাচটা দেখলি? কী ভালো হল, তাই না? আরেকটু হলে গাভাস্কার ঠিক জিতিয়ে দিত। একটুর জন্য হেরে গেলাম।
ও এসব কথায় যোগ না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ত।
এরপর আর কথা বলা যায়?
আমাদের স্কুল শেষ হত চারটের সময়। মধ্য কলকাতার নামী ইংরাজি মাধ্যম স্কুল। বহু পুরনো স্কুল। আমরা সবাই স্কুলের পরে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলতাম। দেখতাম ও বাড়ী যেত না। মাঠের পাশে এসে চুপ করে বসে খেলা দেখত। কিন্তু চোখে মুখে কি যেন বিষণ্ণতা। ডাকলেও খেলতে আসত না। মনে হত যেন ও এক অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। মাঠের পাশে বসে থাকলেও ওর সঙ্গে আমাদের সত্যিকারের দূরত্ব যেন তার থেকে অনেক বেশী।
ক্লাসে সব সময় আমার পাশে বসত। তাই দেখতে পেতাম ইতিহাসের ক্লাসে খাতা বার করে কিসব হিজিবিজি কাটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পড়ানো হচ্ছে, ও কিছু না শুনে পাতায় কি সব হিজিবিজি লিখে যাচ্ছে। এসব করলে যা হয় আর কি! মাঝে মধ্যেই ক্লাসে পড়া না পারার জন্য বেঞ্ছির উপরে বা ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। ওর তাতে কোনরকম লজ্জা হত বলে মনে হত না।
শুধু ইংরেজিটা খুব ভালো জানত। ওটাতে সবার থেকে বেশী নাম্বার পেত। বাংলা আর ইংরাজি মিশিয়ে সব সময় কথা বলত। মনে হত বাড়ীতে ইংরাজিতেই বেশী কথা বলে। এছাড়া ও ছবি খুব ভালো আঁকত। টিফিন পিরিয়ডে চুপচাপ বসে ছবি এঁকে যেত। ওর খাতা ভরা থাকত ছবিতে। অবাক হয়ে দেখতাম। শুধু ভালো আঁকার জন্য নয়। সে সব ছবি যেন কোন অচেনা দেশের, কোন অচেনা সময়ের। পাহাড়ের ছবি। সবুজে ঢাকা উপত্যকার ছবি। রাস্তার পাশ দিয়ে কাঠের বাড়ী, পাইন গাছের ছবি। বুঝতে পারতাম ও কোন বিদেশী বই থেকে দেখে আঁকে।
আমি মামাবাড়ীতে মানুষ। মা খুব কম বয়সে মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। তারপর থেকে আমি মামাবাড়ীতেই বড় হই। স্কুলে পড়ার সময় মাকে আর বাবাকে খুব মিস করতাম। অনেক সময় আমিও আমার স্বপ্ন রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মনের মধ্যে পাওয়া না পাওয়া জগতের জিগস পাজল জুড়ে জুড়ে স্বপ্ন তৈরি করতাম।
মাঝে মধ্যে মনে হত রায়ানের সঙ্গে কোথায় যেন আমার মিল আছে। সেজন্যই হয়ত আমরা দুজনে দুজনকে বুঝতে পারতাম। কিছুদিনের মধ্যে আমরা খুব বন্ধু হয়ে গেলাম।
স্কুলের লাইব্রেরীতে খুব কম ছেলেই নিয়মিত যেত। আমি আর রায়ান নিয়মিত যেতাম। ভালো বই কিছু পড়লে ওকে বলতাম, ও আবার কিছু ভালো বই পড়লে আমাকে সাজেস্ট করত।
কিন্তু ক্লাসে সেই একই রকম অন্যমনস্ক থাকত।
আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – রায়, তুই মন দিয়ে কিছু শুনিস না কেন? শুধু শুধু এতো শাস্তি পাস।
-আই কান্ট ফলো দেম। এ লট অফ ব্যাক গ্রাউন্ড নয়েস। যেন সবাই সবসময় ফিসফিস করছে। টীচার কি বলছে কিছুই বুঝতে পারি না। আমি শুধু তোর কথা বুঝতে পারি।
- সে কি? তুই ডাক্তার দেখাস নি? হয়ত কানে কোন কিছু হয়েছে। আমার দিদারও এরকম হয়।
ও আর কিছু বলে নি।
ও আমার সঙ্গেও খুব বেশী কথা বলত না। কিন্তু তাও যেটুকু বলত, তা শুধু আমার সঙ্গেই। লক্ষ্য করতাম ও আমাকে ছাড়া আর সবাইকে এড়িয়ে চলে। বলতে নেই আমার বেশ ভালোই লাগত সেটা।
কিছুদিন বাদে ওকে একদিন আমার বাড়ী নিয়ে এলাম। আমার বাড়ী মানে মামাবাড়ী। বড়মামার কাছ থেকে দাবা খেলতে শিখেছিলাম। ওকে শিখিয়ে দিলাম। আমার থেকে শিখে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ও বেশ ভালো খেলতে শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে এমন হল যে প্রায় নিয়মিতই ওর কাছে হারতাম। আসলে ওর বুদ্ধি বেশ ভালই ছিল।
মাঝে মধ্যেই স্কুল ফেরত আমি ওকে বাড়ী নিয়ে আসতাম। দিদিমার ঘরে মেঝের উপরে বসে দাবা খেলতাম। দিদিমা ওকে খুব ভালবাসতেন। এলেই কুলের আচার, নারকোলের নাড়ু, এসব দিতেন । ও এসব খেতে খুব ভালোবাসত। এমন ভাবে খেত যেন ওকে কেউ কোনদিন এসব খাবার খেতে দেয় নি।
দেখতে দেখতে এভাবে আমরা ক্লাস সেভেনে চলে এলাম। আমি খুব ভালো রেজাল্ট করলেও ও কোনরকমে পাস করেছিল।
একদিন হঠাৎ সুদীপ্ত আমাকে একটা কথা বলল। রায়ানকে নিয়ে। তখন রায়ান কাছাকাছি ছিল না।
ও বলে উঠল – আচ্ছা, তুই তো রায়ের খুব বন্ধু। তোর রায়কে খুব অদ্ভুত মনে হয় না।
আমি একটু অবাক হলাম। হঠাৎ করে এরকম প্রশ্ন।
ও ফের বলে উঠল – ওর বাড়ী গিয়েছিস কখনও?
-না, কেন তুই গিয়েছিস?
-না, আমি ভেবেছিলাম তোকে অন্তত কোনদিন নিয়ে গেছে। এতো বন্ধুত্ব তোদের।
-না, কিন্তু কেন বল তো?
-আমাদের সবার বাড়ী থেকে কেউ না কেউ অনেকদিন স্কুলে আসে। খোঁজ খবর করে। টিচারদের সঙ্গে দেখা করে। স্পোর্টসের দিন আসে। ওর কাউকে কোনদিন আসতে দেখেছিস?
-না। কিন্তু তাতে ও কি করবে? অবাক হওয়ার কি আছে?
সুদীপ্ত একটু বেশী সন্দেহবাতিক। ফের বলে উঠল। এবার একটু কাছে এসে।
-আমি সেদিন ওকে পার্কস্ট্রীটের কবরখানায় দেখেছি। আমি পিসির বাড়ী গিয়েছিলাম। ওরা ঠিক কবরখানার পাশেই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। তখন রাত ন’টা হবে। ওটা বন্ধ হয়ে যায় ছ’টা নাগাদ কিন্তু কি দেখলাম জানিস?- বলে ও চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে রহস্যজনকভাবে তাকাল।
-কি?
-রায় ওর মধ্যে ঘুরছিল। তারপরে একটা ভাঙ্গা মার্বেলের সমাধির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে আবার আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলো।
-তুই অন্ধকারে ঠিক দেখেছিলি?
-হ্যা, একদম। দূর থেকে হলেও স্পষ্ট দেখেছি। ওখানে আলো ছিল। আমার চিনতে ভুল হয় নি। তোর তো খুব বন্ধু। ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখিস গিয়েছিল কিনা!
- কিন্তু সে তো যেতেই পারে! হয়ত ওর কোন আত্মীয়ের সমাধি আছে।
-তা বলে অত রাতে? ওরকম জায়গায় তুই পারবি একা যেতে? ঢুকলই বা কোথা থেকে কে জানে?
-নির্ঘাৎ ঢোকার অন্য কোন পথ আছে।
সুদীপ্ত মাথা নেড়ে বলেছিল- তাই হবে হয়ত।
আমি পরে রায়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর না দিয়ে কিরকম যেন উদাসী চোখে তাকিয়েছিল। যেন ওই জায়গাটাই ও চেনে না।
তবে আমার ওর উপরে খানিকটা অভিমান হয়েছিল। আমার বাড়ীতে ও অনেক দিন এসেছে। কিন্তু আমাকে কোনদিন ও ওর বাড়ীতে যেতে বলে নি। হতে পারে ওরা অনেক বড়লোক। কিন্তু কোনদিন কি আমাকে ওর বাড়ীতে ডাকতে পারত না! ও কোনদিন বাসে যায় না। স্কুল থেকে হেঁটে যায়। নিশ্চয়ই বাড়ী খুব বেশী দূরে নয়। আমার মামাবাড়ী সেখানে অনেকটা দূর। কিন্তু তা সত্বেও ও কত দিন এসেছে। আমি বলি বলেই না এসেছে!
ও না বললেও কয়েক মাস বাদে সে সুযোগ এসে গেল একদিন।
আমার ছোট পিসির ফ্ল্যাট ছিল ময়দানের কাছে। রাসেল স্ট্রীটে। অনেকদিন যাই নি।। পিসেমশাই ব্যাংকের খুব বড় অফিসার। সেদিন ছিল রোববার। পিসির বাড়ীতে সারাদিন দারুণ খাওয়াদাওয়া হল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সন্ধের দিকে বেরোলাম বাড়ী ফিরব বলে। তখনো কলকাতায় মেট্রো চালু হয় নি। খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাসস্টপ।
ভেবেছিলাম নিজে নিজে পথ চিনে বাসস্টপ খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু ভুল করলাম। বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অলিগলি দিয়ে যেতে গিয়ে খানিকবাদেই পথ হারালাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পথে একটা পার্ক পড়ল। শহরের এই দিকটার সঙ্গে আমার একদম পরিচয় না থাকায় ঘুরপাক খাচ্ছি, কি করব ভাবছি, হঠাৎ মনে হল কিছু দূরে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে।
খুব পরিচিত হাঁটা। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম এটা রায়ান । চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম। প্রথমে সাড়া দিল না। তারপর দ্বিতীয়বার ডাকার পর ঘুরে তাকাল। আমাকে দেখে চমকে উঠল। তারপর আনন্দে ছুটে এগিয়ে এলো।
-তুই এখানে?
-আমার পিসীর বাড়ী এখানে। কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?
ওর হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ছিল। সেটা ডান হাত তুলে দেখিয়ে বলে উঠল- কিছু জিনিষ কিনতে গিয়েছিলাম। আমি তো এখানেই থাকি। একদম কাছে। হান্ড্রেড ইয়ারডস ফ্রম হিয়ার।
-দারুণ । চল , তোর বাড়ী দেখে আসি। ওখানে গিয়ে গল্প করে তারপরে খনিকবাদে বেরবো।
- এতো রাতে? তোর ফিরতে আসুবিধে হবে না?
-না, ঠিক কিছু একটা পাওয়া যাবে।
ও যেন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপরে বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে বলে উঠল- তবে চল। বাট ইট মাইট গেট টু লেট ফর ইউ।
ওর সঙ্গে সঙ্গে এগোলাম। এটা মধ্যকলকাতার বেশ উচ্চবিত্তদের এলাকা। উত্তর কলকাতার মতো গায়ে গায়ে বাড়ী নেই। বেশীর ভাগই ফ্ল্যাট এ এলাকায়। মাঝে মধ্যে বিশাল জায়গা জুড়ে দেওয়াল ঘেরা সামান্য কিছু বাড়ী।
সেরকমই একটা বাড়ীর সামনে এসে আমরা এসে দাঁড়ালাম। বেশ বড় বাড়ী। বাইরের বড় গেট ঠেলতেই খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকতেই অবাক হলাম।
মধ্য কলকাতায় প্রায় শহরে কেন্দ্রে এরকম বাড়ীও হয়? একটা সময় বেশ বড় বাড়ী ছিল। এখন সামনে খানিকটা খোলা চাতাল। অযত্নে বেড়ে ওঠা অজস্র আগাছায় ভরা একটা বাগান। বাগানের এক কোনে একটা নিম গাছ। তারপরে একটা দোতলা বাড়ীর ধবংসস্তুপ।
মনে হচ্ছে বাড়ীর শুধু ইটের শিরদাঁড়াটুকুই টিঁকে রয়েছে। দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অশ্বত্থ গাছের শিরা উপশিরা গজিয়েছে। চারধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে বারান্দা পরে তার বাঁদিকের অংশ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা ইটের দাঁত বেরিয়ে আছে সর্বত্র।
বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছিল। কিন্তু তবু বাড়ীর ভিতরে কোন আলো জ্বলছিল না। মনে হচ্ছিল এ পোড়ো বাড়ীতে সাপ না থাকলেই অবাক হব।
ও আমাকে সামনের একটা ঘরে এনে বসাল। বেশ বড় ঘর। এ ঘরে সামান্য কিছু ভাঙ্গা আসবাব ছড়িয়ে আছে। একদিকে একসময় বড় ফায়ার প্লেস ছিল। এখন সেখানে কিছু ইট পরপর সাজিয়ে রাখা রয়েছে।
ঘরের দেয়াল জুড়ে দামী কাঠের কাজ। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় তা ভেঙ্গে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। মাটির উপরে এককোণে কালো টিনের তোরঙ্গ পরে আছে। ঘরে বেশ কয়েকটা বড় বড় খড়খড়ির জানলা। কিন্তু সেসব জানলার বেশীর ভাগ কাঠই ভাঙ্গা। ঘরের মাঝবরাবর বাহারী রঙ্গিন কাঁচের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। সেটা দিয়ে বাগানটা দেখা যায়। কিন্তু তারও একটা বড় অংশ ভেঙ্গে গেছে।
আমি নিশ্চিত এখানে চোরে ঢুকতেও ভয় পাবে।
-তুই এখানে থাকিস?
-হ্যা।
বুঝতে পারলাম। এজন্যই ও হয়ত আমাকে এখানে আসতে বলে নি। হয়ত বড় কোন অসুবিধে হয়েছে ওদের। আগে হয়ত খুব ভালো অবস্থা ছিল। আমার মামাবাড়ীরও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা ভালো না। কিন্তু সেটাও এ তুলনায় অনেক ভালো।
-তোর বাবা – মা কোথায়?
-ওরা ভেতরে অন্য ঘরে আছে।
একটু অবাক হলাম। কারণ ভিতরে কোন আলো জ্বললে এখান থেকে তার আভাস পাওয়ার কথা। ভেতরের দিকে তাকালে শুধুই কালিঢালা অন্ধকার।
আমাকে একটা পা নড়বড়ে বিশাল কাঠের কাজ করা চেয়ারে বসতে বলে ও আরেকটা ভাঙ্গা চেয়ার নিয়ে সামনে এসে বসল। আমরা নানান বিষয়ে গল্প শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই মনে হল কী যেন একটা অন্যরকম হচ্ছে। ওর কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। যেন খুব কাছেই আরও অনেকে কথা বলছে। কিরকম যেন ফিসফিসিয়ে। অনেকে থাকলে যেমন হয় সেরকম আর কি! ওর কথাও মাঝে মধ্যে তার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল।
তার মাঝে মধ্যে যেন কাপ-ডিশের আওয়াজ। বহু দূর থেকে ভেসে আসা কিছু কথা। তারপর আবার সব চুপচাপ। আবার যেন কেউ ছুটে বেড়াচ্ছে ঘরে। ছোটরা যেভাবে ছুটে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে যেন পোড়া মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। যেন কিছু রান্না হচ্ছে।
এদিক ওদিক দেখে বললাম, এ বাড়ীতে কি আরও অনেকে আছে?
না, না আমি, বাবা আর মা-ই থাকি।
ওর মধ্যে শুরুর দিকে একটা জড়তা ছিল। আস্তে আস্তে সেটা কেটে গেল। ও অন্য একটা ঘর থেকে দাবার বোর্ড নিয়ে এলো। আমরা খেলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে অন্ধকার আরেকটু বাড়তে ও একটা আজব চেহারার বড় হ্যারিকেন নিয়ে এলো। তার আলো বেশ জোরালো। আমরা সে আলোয় খেলতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে হল ভিতরের ঘর থেকে কেউ যেন জোরে জোরে কথা বলছে। কিন্তু আগের মতোই কোন কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সেটা বাংলা না ইংরাজিতে বলছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। শুদু মনে হচ্ছে যেন একাধিক লোক –উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। নারী পুরুষের গলা তার মধ্যে মিশে আছে।
রায়ান একটু যেন বিব্রত হয়ে আমাকে বলে উঠল,- দাঁড়া একটু ভেতর থেকে ঘুরে আসছি। আই উইল বি ব্যাক ইন মিনিটস।
ও ভেতরের ঘরে চলে গেল। আর তখনই যেন বাকি শব্দের চরিত্র আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম। কেউ যেন দূরে পিয়ানো বাজাচ্ছে। কোথাও যেন পার্টি হচ্ছে। কাঁচের গ্লাসে গ্লাসে ধাক্কা লাগার টুং- টাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে যেদিকে রায়ান গেলো, সেদিকে একবার উঁকি মারলাম।
অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোন আলো জ্বলছে না। কি মনে হল, দেওয়ালে হাত রেখে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিল সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এ দেওয়াল যেন বরফ শীতল, ভিজে ভিজে। পায়ের তলার মেঝে এবড়ো খেবড়ো, নানান জায়গায় ভাঙ্গা।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজটা দিয়ে ফুট তিনেক যেতেই বুঝলাম আর এগোনো প্রায় অসম্ভব। হ্যারিকেনের আলো আর সামনে যাচ্ছে না। কিন্তু স্পষ্ট ওই আওয়াজটা ভেসে আসছে। ঠিক এমনসময় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া যেন আমাকে ধাক্কা মেরে গেলো। হঠাৎ করে একটা স্ট্যান্ডিং ফ্যানের সামনে গিয়ে পড়লে যেরকম হয়। চমকে উঠে পড়ে যাচ্ছিলাম।
কোনরকমে সামলে নিলাম। তারপরে হাতড়ে হাতড়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। মনে হল একটা বড় ডাইনিং রুমে এসে পড়েছি।।
ঘরের মধ্যে অন্ধকার থাকলেও একপাশের বড় কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের আলো সামান্য এসে পড়েছে। সে আলোয় বুঝতে পারলাম যে ঘরটায় এসে পড়েছি, সেরকম বড় ঘর আমি আগে কখনও দেখি নি। ঘরের মাঝ বরাবর একটা বিশাল ডিম্বাকৃতির ডাইনিং টেবল। কাঠের কাজ করা। প্রায় পনেরোটা চেয়ার রাখা বিশাল টেবিলটাকে ঘিরে।
হঠাৎ হার্ট বিট যেন বন্ধ হয়ে গেলো।
এর মধ্যে কয়েকটা চেয়ার ফাঁকা নেই। সেখানে লোক বসে আছে। যারা বসে আছে, তাদের সবার দৃষ্টি আমার দিকে। একজন বিশালদেহী সাহেব। সুট -টাই পরা, নীল চোখে আমার দিকে কড়াভাবে তাকিয়ে আছে। পাশে নীল গাউনপরা এক বছর চল্লিশের মহিলা। ইনি ভারতীয়। কালো চুল। যেন আমার মায়ের মতো দেখতে। অন্য দুটো চেয়ারে দুটো আঁট -নয় বছরের বাচ্চা। উপরে বড় একটা ঝাড় লন্ঠন । কিন্তু কোন আলো জ্বলছে না।
ঘরে অন্ধকারের মধ্যে মিশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনজন। না , তিনজন নয়। চারজন। তার মধ্যে তিনজন ভারতীয় । দেখে মনে হচ্ছে কাজের লোক। একজন হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আরেকজন ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ মহিলা। মনে হয় বাড়ীর হাউসকীপার। সাদা গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ঘরে কোন আলো নেই। চেয়ারেও সবাই যেন স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। যেন সময়ের একটা মুহূর্তে আটকে আছে।
ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আবার সাহেবের দিকে তাকালাম। এখনও আমার দিকে একই ভাবে তাকিয়ে আছে। মুখ যেন রাগে লাল হয়ে গেছে।
কে যেন হঠাৎ আমার হাত এসে ধরল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রায়ান। হাত ধরে আবার আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো আগের ঘরে।
ওর ফরসা মুখ যেন একটু লাল হয়ে গেছে। আমাকে বলে উঠল- তুই কোথায় যাচ্ছিলি! ইউ শুডন্ট হ্যাভ লেফট দিস রুম। আমার বাবা একটু রাগী মানুষ। তাছাড়া ভারতীয়দের ভালো চোখে দেখেন না।
-কিন্তু কেন?
-সে জানি না। তোর আর এখানে থাকা উচিত হবে না। রাতও হয়েছে।
সত্যি রাত হয়ে গিয়েছিল। বাড়ীর মধ্যে কোথা থেকে গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের গম্ভীর গলায় আটটা ঘণ্টার শব্দ ভেসে আলো। যেন সেও আমাকে অবিলম্বে চলে যেতে বলছে। আমি উঠে পড়লাম। রায়ান আমার হাত ধরে বাগান পেরিয়ে গেট অব্দি এলো। বাইরে রাস্তার আলো জ্বলছিল।
বেরোনোর সময় দেখলাম, তখনও বাড়ীর অন্য কোন ঘরে আলো জ্বলছে না। এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে আমার চোখ যেন আরও বেশী করে সব কিছু দেখতে পাচ্ছিল। রাস্তায় এসে পড়লাম।
সেদিন মামাবাড়ীর ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। বাড়ীতে বেশ বকুনি খেয়েছিলাম। আসলে সে সময় মোবাইল ফোন ছিল না যে ইচ্ছে করলেই জানিয়ে দেওয়া যাবে। না জানিয়ে অত রাতে ফেরায় বাড়ীর সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।
এর দুদিন বাদের কথা। অঙ্কের ক্লাস ছিল শেষে। ও আমাকে আগেই বলে রেখেছিল স্কুল শেষ হওয়ার পরে একটু থাকতে। স্কুল শেষ হতে আমাকে ওর ব্যাগ থেকে একটা ছোট ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বার করে দিল।
বলে উঠল – এটা তোকে দিলাম। ইউ আর মাই বেসট ফ্রেন্ড। তোকে দেওয়ার জন্য এটা আমি এঁকেছি।
ছবিটা দেখে অবাক হলাম। হেসে উঠে বলে উঠলাম – খুব সুন্দর। এ আবার কোন জায়গার? কি ফুল এটা?
আসলে সে ছবিতে ছিল একটা পাথরের স্মৃতি ফলক। তার পিছনে একটা অচেনা বড় গাছ। সে গাছে কোন পাতা নেই। তাকে ঘিরে ঘাসের মধ্যে ফুটে আছে অনেক হলুদ ফুল। ড্যাফোডিল। তখন অবশ্য ওই ফুলের নাম জানতাম না। আমি সেরকম আগে দেখিও নি। জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল ড্যাফোডিল। ওর ফেভারিট ফুল। ইংল্যান্ডে নাকি অনেক ওই ফুল ফোটে।
ওর আঁকার হাত চিরকালই খুব ভালো ছিল। ওই স্মৃতিফলকের অংশটা বাদ দিলে ছবিটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – কিন্তু এখন তো আমার জন্মদিন নয়। হঠাৎ করে এরকম গিফট?
ও হেসেছিল। তার পরে বলেছিল- সো দ্যাট ইউ ক্যান রেকগনাইজ মি। চিনতে পারিস।
-ধুর, তোকে আমি কোনদিন ভুলে যাব নাকি! সম্ভবই নয়। তাছাড়া তুই তো আর স্কুল ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস না।
একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ও বলেছিল- হয়ত, আমাকে যুদ্ধে যেতে হল। হঠাৎ করে স্কুল ছেড়ে। আর ফিরে এলাম না। তখন?
-এখন, যুদ্ধ?
তখন হাসলেও, এর পরের দিন ও স্কুলে আসে নি। তার পরের দিনও না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওর বোধহয় জ্বর হয়েছে।
কয়েকদিন আসছে না দেখে আমি ওই পাড়াতে গিয়েছিলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে বাড়ীটা পেলাম। তখন বিকেল চারটে। বাইরে দিনের আলো তখনও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সেদিনকার মতো গেটটা ভেজানো নেই। ভেতর থেকে তালা বন্ধ। একটা নয়, বেশ কয়েকটা বড়োসড়ো তালা। গেটের ফাঁক দিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হল না কেউ এখানে থাকে। এমন কি কেউ কোনদিন এখানে ছিল বলেও মনে হল না।
প্রথমদিন আধোঅন্ধকারে যেটুকু পরিচয় পাই নি, সেটা সেদিন ভালো করে পেলাম। একটা আগাছায় ভরা বাগান, তারপরে একটা সম্পূর্ণ পোড়ো বাড়ী, যেখানে গত দশ বছরে কেউ থেকে থাকলেই অবাক হব।
দিনের বেলাতেই কিরকম যেন গা ছমছম করছে।
রাস্তার উল্টোদিকে একটা বেশ বড় গাড়ীবারান্দাওয়ালা আধুনিক বাড়ী। তার গেটে বেশ একজন জাঁদরেল উর্দিপরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সাহস করে তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। রায়ানকে এখান থেকে বেরোতে দেখেছে কিনা।
সে বেশ অবাক হয়ে বলে উঠল – না, ঊখানে তো কেউ কুনোদিন থাকে না। আমি কাউকে ঢুকতে বেরোতে কোনদিন দিখি নাই।
আমি ফের বলে উঠলাম- আমার বন্ধু ওখানে থাকে। তিনদিন আগেও এসেছি।
আমাদের কথাবার্তা শুনে ইতিমধ্যে ভেতর থেকে দেখি এক চশমা পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছেন। মনে হল উনি এ বাড়ীর মালিক। আমাদের কথোপকথন শুনেছেন।
আমাকে একটু অবাঙ্গালীটানে বাংলায় বলে উঠলেন - এ তো এ পাড়ার একমাত্র পোড়ো বাড়ী। আমি কুড়িবছর এখানে আছি। কাউকে কোনদিন দেখি নি। শুনেছি এক সময় বেনেট ফ্যামিলি থাকত এখানে। সাহেব নাকি বেজায় ভারতীয় বিদ্বেষী ছিল। একবার এ বাড়ীতে স্বাধীনতার আগে হামলাও হয়েছিল। ম্যাথু বেনেট হাইকোর্টে জাজ ছিলেন। একমাত্র ছেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা যায়। পরে সাহেব আর মেমসাহেব দুজনেই এখানেই মারা যায়। বহুবছর কেউ থাকে না এ বাড়ীতে। কিছু লিগাল গণ্ডগোলের জন্য বাড়ীও বিক্রি হয় নি।
-সে কি করে হয়? আমার বন্ধু এখনও ওখানেই থাকে।
লোকটা এবার হেসে উঠল। বলে উঠল- তোমার বন্ধু তাহলে মানুষ নয়, ভূত হবে।
শুনেই গা কিরকম ছমছম করে উঠল। আমি আর কথা না বলে সোজা বাড়ী ফিরে এলাম। এরপরে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম রায়ানের। ভেবেছিলাম আবার হয়ত ফিরে আসবে। মনে হয় সেদিন ইচ্ছে করে আমাকে ভুল বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত কোন কারণে ও ওর বাড়ীতে আমাকে নিয়ে যেতে চায় নি। ওই বাড়ীর গেট খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছিল। এ ছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে!
কিন্তু না আর কোনদিন ওর দেখা পাই নি। ও আর কোনদিন স্কুলে আসে নি।
আসল অবাক হলাম এর কিছুদিন পরে। ওর কথা অন্য কেউ জানে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে। ক্লাসে যতজন ছিল, তারা কেউ নাকি ওকে কোনদিন দেখে নি। বারবার করে ওর চেহারা, কথা বলার ধরণ বলার পরেও কেউ ওর কথা খেয়াল করতে পারল না। উলটে বলে কিনা আমার মাথা খারাপ।
কি আশ্চর্য। সবাই কিভাবে ওকে ভুলে যেতে পারে! সবাই আমার সঙ্গে মজা করার জন্য মিথ্যে বলছিল কিনা কে জানে!
বাধ্য হয়ে কয়েকজন টীচারকেও জিজ্ঞেস করলাম। না কেউ ওকে কোনদিন দেখে নি। নামও শোনে নি। ওই নামের কোন ছেলে নাকি কোনদিন স্কুলে পড়ে নি। বললাম যে ও অনেক সময় ক্লাসে বেঞ্ছির উপরে দাঁড়িয়ে থাকত। বাইরে নীল ডাউন হয়ে বসার শাস্তি পেত। কিন্তু শুনলাম সেরকম শাস্তি নাকি আমি নিজেই বেশী পেয়েছি।
বেশ বুঝতে পারছিলাম প্রশ্ন শুনে আমি স্বাভাবিক আছি কিনা, সেটাই সবাই সন্দেহ করছে।
সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম সেদিনের কথাটা। ও তো আমাকে রায়ান সম্বন্ধে বলেছিল।
ও শুনে অবাক হয়ে বলে উঠল- এজন্যই তুই এতো অন্যমনস্ক থাকতিস। নিজের মনে যেন মাঝে মধ্যে বিড়বিড় করতিস। আমি আবার কবে বললাম যে আমি কাউকে পার্ক স্ট্রীটের কবরখানায় দেখেছি। সে তো তুই বললি যে তুই নাকি একটা ছেলেকে ওখানে দেখেছিস। সে নাকি আবার তোর খুব বন্ধু হয়।
আর কথা বাড়ালাম না ওর সঙ্গে।
শেষ ভরসা দিদিমা। দিদিমা ওকে কতো ভালবাসতেন। আমরা দিদিমার সামনেই খেলতাম। সেটা উনি মন দিয়ে দেখতেন। কিন্তু এবারেও জিজ্ঞেস করে অবাক হলাম। দিদিমা বললেন আমি নাকি একা দাবা খেলতে খেলতে বিড় বিড় করে কথা বলি। দুজনের চাল দিই।
আর কুলের আচার আর নারকেল নাড়ু? সে নাকি আমিই খেয়েছি।
এর পরে আর কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। এ যেন একটা স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নটা আমার কাছে আমার জীবনের থেকেও জীবন্ত। আমার ছেলেবেলার একটা খুব বড় অংশ। ওর উপস্থিতি আর কারুর কাছে ধরা না পড়লেও আমার কাছে যে সেটা সত্যি ছিল, সেটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ হয় নি। ওর মতো আর কোন বন্ধুও হয় নি। এতো বছর বাদে অনেক কিছু ভুলে গেলেও ওর সব কথা তাই স্পষ্ট মনে আছে।
কতো বছর কেটে গেছে। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম রায়ানের কথা। আমি এখন ইংল্যান্ডে থাকি। মাঝে প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। সেই ছবিটাও হারিয়ে গেছে। তবে মন থেকে যে সে ছবিটা হারায় নি, সেটা টের পেলাম এতো বছর বাদে।
সামনে ঠিক সেই ছবি। সেই রকম ড্যাফোডিল ঘেরা বারচ গাছ। তার নিচে সেই স্মৃতি ফলক।
তাতে লেখা,
ইন মেমারি অফ,
রায়ান বেনেট
রয়্যাল ওয়ার উইকশায়ার রেজিমেন্ট
কিলড ইন অ্যাকশন, থার্ড মার্চ ১৯৪৫
আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমার ছোটবেলার বন্ধুর সামনে। এ রায়ান আমার বন্ধু রায়ান ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।
আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম- আই রেকগনাইজ ইউ রায়ান। আমি সবসময়ই জানতাম যে তুমি ছিলে। আমি তোমাকে আজও ভুলি নি। ভালো থেকো বন্ধু।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
ওয়ারউইক, ইংল্যান্ড

Thursday, May 6, 2021

Review Kaushik Dam

 Koushik Dam cinema galpo

খুব ভালো লাগল
Abhijnan Roychowdhury দা এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা লেখক এবং অতি অবশ্যই এক বিরল শ্রেণির লেখক যাকে ছোটদের , কিশোর দের বা বড় দের লেখক বলে শ্রেণীভুক্ত করা যায় না।
ওঁর লেখা গুলো পড়লে কিছু না কিছু শেখা যাবেই। এই লেখায় বিজ্ঞান আর ঈশ্বর চেতনা এমনভাবে মিলে মিশে গেছে তা ভাবাই যায় না। " সামনে রোমিত বসে কাঁদছে। ..... ও সত্যি হয়তো ওদের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিল। তাই শুনতে পাচ্ছিল।" এই লাইন গুলো যখন পড়বেন তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। লেখাটা কিশোর ভারতীর 5 ই এপ্রিল সংখ্যায় ছোট গল্পের থেকে পড়লাম। এই খানেই আমার একমাত্র অভিযোগ .... আগেও বেশ কয়েকটা অনিলিখা কে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রেও আমি লক্ষ্য করেছি সেটা হল একটা উপন্যাসের পর্যায়ের লেখাকে বেশ জোর করে ছোট গল্পে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই গল্পটা একটা 200 পাতার উপন্যাস হতেই পারতো, তাতে হয়তো আরো অনেক কিছু আমরা জানতে পারতাম, শিখতাম ফিজিক্স শিখতাম বেদ মন্ত্র।

শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তী সাহিত্যিক অনীশ দেবের আমার লেখা সম্বন্ধে কিছু কথা। সব লজিকের বাইরে।

 জানতাম না যে পত্রভারতীর থেকে প্রকাশিত ‘সব লজিকের বাইরে’ বই এর ভূমিকা লিখবেন আমার প্রিয় কিংবদন্তী লেখক অনীশ দেব।


হয়ত জানলে একটু ভয়ই পেতাম। কারণ ওঁর মতো স্পষ্টবক্তা মানুষ কোন কিছু দ্বিধা না করে যেরকম মনে হবে সেরকমই লিখবেন।

অনেকে ওঁর হাতের লেখা দেখতে চাইছেন। ওঁর মুক্তাক্ষরে লেখা এই ভূমিকাটা আমার কাছে খুব বড় ঐশ্বর্য হয়ে থাকল।

পড়লেই বুঝবেন উনি কোথায় অন্য অনেকের থেকে আলাদা। মন কতো বড় হলে কল্পবিজ্ঞানের সম্রাট এরকম ভূমিকা স্বেচ্ছায় অনুজ এক লেখক সম্বন্ধে লিখতে পারেন।



আমাদের সবার হাতে রক্ত। দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।

 কয়েকজনকে দেখছি প্রধানমন্ত্রীর হাতে রক্ত দিয়ে একটা পোস্ট করছেন। এটা কী ধরণের অসভ্যতা। রক্ত তো আমাদের সবার হাতেই লেগে রয়েছে। সব দলের নেতাদের হাতে। এখন ন্যাকামি করা হচ্ছে। এখনও রাজনীতি! সত্যি আমাদের রক্ত দূষিত হয়ে গেছে রাজনীতি করে করে। এখন দেখা উচিত কীভাবে একসঙ্গে কাজ করেএই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যায়।

কোন দলের মুখস্থ করা কিছু কথা আমার টাইমলাইনে এসে বলবেন না।

ভারতবিরোধী কথা কী বলতেই হবে! শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকা হয় । প্রধানমন্ত্রীর কী কোন দায় নেই! অবশ্যই অনেক আছে।

সব মিলিয়ে যত ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তাতে চীন আর আমেরিকার পরেই ভারতের অবস্থান। কিন্তু আরও ১০% বেশী হয়ত দেওয়া যেত।
আমাদের কখনই ভাবা উচিত হয় নি যে সেকেন্ড ওয়েভ আর আসবে না। স্প্যানিশ ফ্লুতেও সব থেকে বেশী মানুষ মারা গিয়েছিল এই সেকেন্ড ওয়েভে। যে ক’টা দেশে মিউট্যান্ট ভাইরাস আসার সম্ভাবনা ছিল, তার মধ্যে ভারত ছিল।
কোভিড হাসপাতাল কেন আরও বেশী খোলা হয় নি।
ইলেকশান উপলক্ষে জনসমাবেশ করতে দেওয়া একদমই উচিত হয় নি।

বিভিন্ন প্রান্তে ভাইরাস সিকোয়েন্স- তাড়াতাড়ি বোঝার জন্য রিসার্চ সেন্টার আরও তাড়াতাড়ি খোলা উচিত ছিল। একই সঙ্গে এরকম B.1.617, B.1.1.7 স্ট্রেন যে এভাবে ভারতীয়দের সংক্রামিত করবে সেটাও ধারণার বাইরে ছিল।
কিন্তু কিছু রাজ্য সরকার- তারাই বা কী করেছে? সাধারণ জনতার একটা বড় অংশ তারাও কী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে!

আমি হাজারটা জিনিস তুলে ধরতে পারি যেখানে রাজ্য সরকার শুধু অন্ধবিরোধিতার জন্য তাদের দায়িত্ব পালন করে নি! কিন্তু এখন সে সব ভুলে এসব নেগেটিভ কথায় না মেতে মানুষের সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।

পরিবর্তন আর কিছু নির্ভীক কথা

 পরিবর্তন হয়ত এবারে আসবে।

আবার বিক্রিত পত্রিকার বিকৃত সম্পাদকীয়ের সুর বদলে যাবে। কবিতার শব্দচয়ন পাল্টে যাবে। গদ্যের ভাষা বদলে যাবে। শিকড় নতুন জমিতে গড়বে। আগাছা নতুন আলোর সন্ধানে থাকবে। সুযোগসন্ধানীরা বাসা বদলাবে। এখন একটা বড় অংশ এই রাজনীতির কুমিরডাঙ্গা খেলায় জলে আর তাই নামছে না। তারা অপেক্ষায় আছে।
আমরা চাইব সত্যিকারের পরিবর্তন যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, কর্মসংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে, শিক্ষার মানে উন্নতি হবে, শিল্প বাড়বে। দুর্নীতি, বিশৃংখলা আর অপশাসনের বদলে সুশাসন আসবে, যোগ্যতার বিচার অনুযায়ী লোকে চাকরি পাবে। যেখানে মাথার উপরে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়বে না, লক্ষ লক্ষ লোকের টাকা চুরি যাবে না, অনুপযুক্ত লোক অন্যায়ভাবে চাকরি পাবে না, রাজনীতি ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর প্রধান উপায় হবে না।
একটা সময় আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, শ্রী বিধান চন্দ্র রায়, শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, শ্রী অজয় মুখারজীর মতো মানুষরা যাদের কাছে রাজনীতির অর্থ ছিল আত্মত্যাগ। আমরা কখনও তো ভাবি না এঁরা কোন দলে রাজনীতি করতেন। গত চল্লিশ বছর ধরে আমরা শিল্প, শিক্ষাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে পিছিয়েছি। সে জায়গা থেকে খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব -এর মতো সৎ মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরে শিল্পের জন্য ভালো কিছু করতে চাইলেও, বাংলার মানুষ সেটা করতে দেয় নি।
রাজনীতি এখন সবথেকে নির্ভরযোগ্য পেশা, রাজনীতি একটা বড় অংশের জীবিকা শুধু সময় মতো পোশাক বদলালেই হল।
আমরা চাইব রাজনীতিতে ভালো শিক্ষিত মানুষ আসুক। শুধুমাত্র অশিক্ষিত অভিনেতা অভিনেত্রীদের ভিড়ে রাজনীতি যাত্রার মঞ্চ না হয়ে উঠুক। শুধু সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা রাজনীতির উঠোনে মাতামাতি না করুক।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে আব্বাস সিদ্দিকীর মতো নেতার মুখ দেখা যাচ্ছে যা সাম্প্রদায়িকতার অর্থ বদলে দিচ্ছে। ধর্মনিরপক্ষেতা মানে অন্ধের মতো শুধু একটা ধর্মের তোষণ নয়। সাম্প্রদায়িকতা শব্দের অর্থ এখন শুধু সুবিধেবাদী বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দুদের বিরোধিতা। অবধারিতভাবে এ রাজ্যেও ভোটে হিন্দুত্বের ঝড় আসবে যদিও সেটা অভিপ্রেত নয়।
আমরা চাইব সত্যিকারের ধর্ম নিরপেক্ষতা, যেখানে আমরা কাউকে ধর্মের পরিচয়ে দেখব না। চাইব সব জাতি ধর্মের মানুষের একই রকম বিকাশ হোক।
সঠিক পরিবর্তন কিন্তু আপনার হাতেই। আগামী প্রজন্মকে যেন আমরা ভবিষ্যৎহীন অন্ধকারের দিকে আর না ঠেলে দিই। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আপনার সন্তান কাজের সন্ধানে রাজ্যের বাইরে যেতে বাধ্য হোক বা ব্যর্থ হয়ে ঘরের কোনে মুখ লুকোক। আমরা নিশ্চয়ই চাইব না আমাদের রাজ্য আরেকটা সিরিয়া বা আফগানিস্থান হয়ে যাক। আমরা কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছি। আমরা খেলা চাই না, জীবন ফিরে পেতে চাই।
পুনশ্চ
যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা উধাও, অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে কোন রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয় নি, হাসপাতালে বেড কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, কোভিড টেস্টিং করার কোন উপায় নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়, সেখানে এই ফলাফল নিয়ে কাদের উৎসব করার মানসিকতা আছে, জানি না।
ভোটের ফলাফল নিয়ে এই পরিস্থিতিতে কিছু বলা উচিত নয়। তবু বলছি। কারণ গল্প শুরু করে শেষ না করলে তো আর হয় না। আর আমার গল্প কোন দাদা বা দিদি পাওয়ারে এলো, তা দিয়ে নির্ধারিত হয় না।
এবারে ভোটে শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ সামনে আসে নি, শিল্পশিক্ষা বা চাকরির দাবী সামনে আসে নি।
আসলে সেটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালীর দুটো আইডেন্টিটির মধ্যে লড়াই – এ। বাঙালী – অবাঙ্গালী((বাংলা সংস্কৃতি, মনন, সুগভীর চিন্তাভাবনা, বাংলা ভাষা – সাহিত্য যার অঙ্গাঙ্গী অংশ)) ও ধর্মের ভিত্তিতে আইডেন্টিটি।
এই দ্বিতীয় আইডেন্টিটিটা তৃণমূলই তোষণের মাধ্যমে সামনে নিয়ে এসেছিল। বামপন্থী আমলে এটা আড়ালে ছিল।
কিন্তু প্রথম আইডেন্টিটা হল আসল আইডেন্টিটি, বাঙালীর পরিচয়, যা সত্যি অনন্য। যে পরিচয় যে কোন বাঙালী মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর দিয়ে গড়ে ওঠে, সেই পরিচয়। সেখানে বাঙালী সাজা যায় না। তাকে আপনার করতে যা করা দরকার, সেটা বিজেপির নেতাদের জানা ছিল না। সেখানেই তারা সফল হয় নি। এর বাইরে বেশ কিছু ভুলভাল লোক, অভিনেতা- অভিনেত্রী( সব দলেই) দলে নিয়ে এসেছিল, যারা শুধুই স্বার্থের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তবু বিজেপি কিন্তু অনেকটাই সফল। ৮০টা সিট পেয়ে বিরোধী থাকার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা থাকে। বিজেপি দায়িত্বশীল বিরোধীর দায়িত্ব পালন করলে, বাঙ্গালীদের সঙ্গে একাত্ম হলে পারলে, ধর্ম নিয়ে বেশী মাতামাতি না করলে, পরের বার অনেক ভালো ফল করবে। বাংলারও অনেক ভালো হবে।
আমি একই সঙ্গে আনন্দিত ও দুঃখিত(এক সময় যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় এস এফ আই -এর লীডারশিপে ছিলাম) যে বামপন্থীরা তাদের ঔদ্ধত্য, না জেনে মুখস্থ কিছু বুলি আওড়ানোর ও সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতার অভাবের উপযুক্ত জবাব পেয়েছে। শূন্য। ভাবা যায়! আর ফেরার কোন জায়গা থাকল বলে মনে হয় না।
এবার তৃণমূল প্রসঙ্গে আসি। অন্যায়ের শিকড় খুব গভীরে ছড়িয়ে পড়লে হঠাৎ করে তার পরিবর্তন হয় না। কারণ সে শিকড় তৃণমূলস্তরে ছড়িয়ে থাকে। তার পরিবর্তন আস্তে আস্তে হয়। আশা রাখি দিদি তাঁর ভুল বুঝতে পারবেন। নৈরাজ্য না বাড়িয়ে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঠিক পথে এগোবেন। মানুষের বিশ্বাসের উপযুক্ত সন্মান দেবেন।

কল্পবিজ্ঞানের গল্প - ফিরে পাওয়া

ফিরে পাওয়া

অভিজ্ঞান রায় চৌধুরী


-দীপু না?
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সৌম্য, আমার স্কুলের বন্ধু। বারো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। তিরিশ বছর বাদে দেখা। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে ওর? গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাড় জিরজিরে চেহারা। চোখের তলা বসা। মাথা জোড়া টাক। বয়স যেন সময়ের অনেক আগেই চোখে মুখে থাবা বসিয়েছে। একটা রংচটা সবুজ শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অজানা বিষণ্ণতা।
জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম, - কী খবর? এরকম চেহারা হয়েছে কেন? কী করিস এখন?
-বলছি, একটু ফাঁকায় চল, এখানে কথা বলতে অসুবিধা হবে।
ঠিকই, এই ভিড়ের মধ্যে কথা বলা অসম্ভব। ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। এ ওর গায়ের ওপর এসে পড়ছে। যতদূর দেখা যায় শুধুই লোকের মাথা। নানান বয়সের মহিলা পুরুষ বাচ্চা –সবাই উৎসবে মেতেছে। খানিক দূরে দূরে স্টল।তাতে নানান ধরণের পানীয় রাখা। অনেক রকম ফাস্টফুডের স্টল।
প্রায় এক মাইল দূরে স্টেজ। খালি চোখে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। তবে জায়গায় জায়গায় বড় বড় ইলেকট্রনিক স্ক্রিন রাখা, তাতে স্টেজের ছবি দেখানো হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কলাকুশলী একটা মাতাল করা গানের তালে তালে স্টেজের ওপর নাচছে। সেই একই ছন্দে নেচে চলেছে এই মাইল খানেক এলাকায় ছড়িয়ে থাকা দর্শকরা।
কারো যেন কোন পরিচয় নেই, লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। বাঁধন ছেঁড়া আনন্দে পরিচিত- অপরিচিতের দাগ মুছে গেছে। আমি নিজেও খানিক আগে নাচছিলাম। অবশ্য এখনকার দিনে এমনিতেও চেনা অচেনা কথাটার তাৎপর্য হারিয়ে গেছে। চেনা মুখ খুব দ্রুত অচেনা হয়ে যায় - অচেনারা চেনার জায়গা নেয়।
সে যাক গে, পরিবর্তন তো আসবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ভিড় এড়িয়ে ফাঁকা জায়গার খোঁজে সৌম্যর পিছু নিই। খানিক বাদে একটা ক্যাফের দিকে নির্দেশ করে সৌম্য। বলে ওঠে- চল, ওখানেই বসা যাক। দুটো কফির অর্ডার দে। আমার পকেট ফাঁকা।
ওর চেহারা দেখে আগেই বুঝেছিলাম, কথাতেও বুঝলাম- ওর অবস্থা খুবই খারাপ।
দু কাপ এক্সপ্রেসো নিয়ে মুখোমুখি বসলাম। বাইরের উন্মাদনা, চিৎকার, শরতের নীল আকাশ- হাল্কা সাদা নানান নক্সার মেঘের জিগস পাজল ভাঙ্গা-গড়া দেখার মধ্যে যে আনন্দ ছিল –সবটুকু হারিয়ে গেল সৌম্যর মুখের দিকে একঝলক তাকাতেই। দুঃখ-বিষণ্ণতা যে মুখে এত গভীর দাগ কাটতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
কপালে দুই ভুরুর মধ্যে গভীর খাঁজ। আমার দিকে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠল- কেমন আছিস?
-ভালো, একরকম চলে যাচ্ছে।
-কী করছিস?
-আই রোবটসের নাম শুনেছিস? আড্ডা মারার রোবট তৈরি করে। ওরই মার্কেটিং – এ আছি। ‘দুঃখের সময়- সুখের সময়- সবসময়-আপনার সঙ্গী –আই রোবট’- অ্যাডটা দেখেছিস? আমার তৈরি। বেশ একটা নাটকীয় কায়দায় বলে উঠলাম।
কিন্তু উৎসাহটা নিভিয়ে দিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌম্য। কফির কাপটা মুখের কাছে এনে আওয়াজ করে একটা চুমুক দিয়ে ফের বলে উঠল –
-বাড়ি থেকে বেরোস না একদম, তাই না?
-না, তেমন দরকারই হয় না। বাড়িতে থেকেই কাজ করি। ওই, মাঝে মধ্যে রেয়ারলি বেরোই।
-তার মানে খোঁজ খবর কিছুই রাখিস না, তাই তো?
-তা কেন রাখব না? ইন্টারনেট আছে, খবরের কাগজ আছে, টিভি আছে, ফোন আছে, ভার্চুয়াল নলেজ সেন্টার আছে, নিউজ ফিড আছে- চাইলেই ঘরে বসে সারা বিশ্ব। সব খবর রাখি। তা হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন?
মুচকি হাসল সৌম্য। হাসিতে শ্লেষ মাখানো। - বলতো আজ এখানে এত লোকের ভিড় কেন?
কেন আবার ফুটবলে ‘সোনার বাংলা’ জিতেছে বলে। এতবড় একটা টুর্ণামেণ্ট। তাই সরকার থেকেই সব আয়োজন করেছে। উফ চারদিকে যা হুল্লোড়। বিশাল অ্যাচিভমেন্ট।
একটু ব্যাঙ্গের হাসি হাসল সৌম্য। তারপর কফির কাপটা নামিয়ে আমার দিকে তাকাল- তুই না বিজ্ঞানের খুব ভাল ছাত্র ছিলি! সব লজিক হারিয়ে ফেললি নাকি?
চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ভৎর্সনার সুরে ফের বলে উঠল, সব ব্যাটা গাধা। চোখে ঠুলি বেঁধে বসে আছে। তুইও ওদের দলে ভিড়েছিস! আচ্ছা, তোর অবাক লাগে না? সামান্য একটা খেলা- দুটো টিমের মধ্যে – তাও আবার একই দেশের। তা নিয়ে এত হইচই! ওদিকে রোজ লক্ষ লক্ষ লোক না খেয়ে মরছে। জলের অভাবে চাষ-বাস বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তাদের খবরও রাখিনা। সব লজিক আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কাঠের পুতুলের মতো ওদের কথায় উঠছি- বসছি- নাচছি । ওরা যা বলছে বিশ্বাস করছি।
শেষের দিকের কথাগুলো সৌম্য ফিস ফিস করে বলল। কিন্তু ও যে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম। ওর রগের শিরাগুলো দপদপ করছিল।
-ওরা মানে কারা?
-গর্ভনমেন্ট –মিডিয়া-সব একদল হয়ে আমাদের যা বোঝাচ্ছে, আমরা তাই বুঝছি। যা দেখাচ্ছে, তাই দেখছি। ওরা যদি সূর্যকে দেখিয়ে বলে চাঁদ, আমরা ভাবি তাই তো চাঁদ ই হবে।
বাকি কফিটা একচুমুকে শেষ করে সৌম্য বলে উঠল – কাল আসছিস? ময়দানে? মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যারা রওনা হচ্ছে তাদের
জন্য হাততালি দিতে?
কথাটা যেভাবে শেষ করল সৌম্য, তাতে স্পষ্ট একটা ব্যঙ্গ ছিল।
বললাম,- ভাল মনে করেছিস। ঠিক ই তো। কালই তো রকেট লঞ্চ করা হবে শ্রীহরিকোটা থেকে। অবশ্যই থাকব।
-তাহলে কাল দেখা হবে, আজ চলি। বলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল সৌম্য। ফের বলল, তোকে ট্যাগ করে রেখেছি যাতে লোকের ভিড়ে তোকে খুঁজে পেতে অসুবিধে না হয়। -বলে ওর ফোনে আমার আই ডিটা সেভ করে নিল।
এরপর যেরকম হঠাৎ করে এসেছিল, সেরকম হঠাৎ করে বেড়িয়ে গেল। কফির দাম মিটিয়ে আবার আমি ভিড়ে গিয়ে মিশলাম। সৌম্যর সঙ্গে কথা বলে মনে যেটুকু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হয়েছিল তা ভুলতে মিনিট খানেক লাগল। ড্রিঙ্কস হাতে মঞ্চের গানের তালে তালে পা ফেললাম। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম।
পরদিন সন্ধ্যা সাতটা। ময়দানের বেশ খানিকটা দূরে ম্যাগলেভ ট্রেনটা থামল। সেখান থেকে আধঘণ্টার হাঁটা। স্টেশন থেকেই সারি দিয়ে লোক এগিয়ে চলছে। কাউকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। জনস্রোত একমুখী। ময়দানে ঢোকার আগেই আমার ফোনটা বেজে উঠল। সৌম্য। বলল, “দাঁড়া, তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাক। খুঁজে পেয়েছি। পাঁচ মিনিটে আসছি।”
আজকাল টেকনোলজি এত এগিয়ে গেছে যে একজন আরেকজনকে খুঁজে বের করতে জিপিএস বেসড ট্রাকিংয়ের সাহায্য নেয়। আইডিটা জানা থাকলেই হল। খুঁজে বের করা জলের মতো সোজা।
চার মিনিটের মাথায় বাঁ-কাঁধের ওপর হাতটা এসে পড়তেই ঘাড় না ঘুরিয়েই বুঝলাম সৌম্য এসে গেছে।
“চল, আর তো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ।”
ওর সঙ্গে এগোলাম। এটা একটা আলাদা মজা। হাজার হাজার, ভুল বললাম, লক্ষ লক্ষ লোক বড়ো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে শ্রীহরিকোটা থেকে লাইভ ভিডিও দেখানো হচ্ছে। সবার হাতে চিপস, পপকর্ন, কোল্ড ড্রিঙ্কস। চোখে মুখে উত্তেজনা। রকেট লঞ্চের আর কয়েক মিনিট বাকি। যারা এসেছে তাদের মধ্যে ক’জন স্যাটেলাইটের অর্থ বোঝে, তাও জানি না। তবে এরকম একটা সেলিব্রেশন দেখার বিনা পয়সার মজা কে মিস করে!
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সৌম্য বলে উঠল, “কী, টেনশন হচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ, তা তো একটু হবেই। ভারত থেকে মঙ্গলে ফার্স্ট টাইম একশোজন সাধারণ লোককে নিয়ে মহাকাশ ভ্রমণ। স্পেস ট্রাভেল। একটু ভুল হলেই কী হবে বল তো? আর কত খরচ!”
“ভুল হবে না। সব দেখবি সময়মতো হয়ে যাবে। ঠিক যেমন অন্য সব মিশনেও হয়। আসলে অভিযান হলে তবে তো ব্যর্থতার প্রশ্ন! সব ধাপ্পা!”
আমি সৌম্যর কথার উত্তর দিলাম না। ওর মাথার যে একটু গণ্ডগোল হয়েছে তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো ময়দান জুড়ে কয়েক মিনিটের নীরবতা। দু-একটা বাচ্চার কান্না আর বায়নার শব্দ। এর মধ্যেই হঠাৎ হাততালির ঢেউ তুলে জায়ান্ট স্ক্রিনে লঞ্চ ভেহিকল ASLV-50 মাটি ছেড়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ড। স্পেস-ক্র্যাফটটা ফোকাসের বাইরে হারিয়ে
যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ফুটে উঠল ‘মিশন সাকসেসফুল’।
হাত তুলে পাগলের মতো লাফাতে শুরু করলাম। ঠিক যেমন আমার আশেপাশের হাজার খানেক লোকও আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফাচ্ছে। কেউ জামা খুলে আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে, তো কেউ আনন্দে মাটিতে বসে পড়েছে। কেউ বা মদের নেশায় কী যে বলছে তার কোনও ঠিক নেই। একটা দেশাত্মবোধক গান শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ সৌম্যর দিকে চোখ পড়ল। ঠোঁটের কোণে হাসি। জিনসের দু’পকেটে হাত দিয়ে একইভাবে চারদিকের পরিবেশের মধ্যে নিতান্তই বেমানানভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল, “আচ্ছা, তোর একবারও মনে হয় না যে এসব সাজানো?”
“মানে?”
“পুরোটাই সাজানো। কোনওরকম লঞ্চই হয়নি। পুরো ভিডিওটাই আগে থেকে তৈরি। লোক ঠকানো!”
“কী বলছিস! তোর মাথার ঠিক আছে? এ নিয়ে একমাস ধরে এত লেখালেখি হচ্ছে। কত মিডিয়া ছিল দেখলি না লঞ্চ সাইটে? স্যাটেলাইট লঞ্চ স্টেশনের কন্ট্রোল রুমটাও দেখাচ্ছিল। কত সায়েন্টিস্ট! সব মিথ্যে?”
“হ্যাঁ, মিথ্যে। সব ধাপ্পাবাজি। আসল ইস্যু থেকে লোকের মন সরিয়ে রাখার জন্য। আচ্ছা দীপু, আজকের দিনটা তোর খেয়াল আছে? ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আজকে পৃথিবী মঙ্গল থেকে অনেক দূরে থাকে। কখনও আজকের দিনে এই অভিযান হওয়া উচিত? আজ পাঠালে সেই স্পেস-ক্রাফট মঙ্গলে পৌঁছবে ২০২৫-এ, যেখানে এ-বছরের নভেম্বরে পাঠালে ওটা মঙ্গলে পৌঁছবে ২০২৪-এ। এই সময়ে পৃথিবী মঙ্গল থেকে সব থেকে দূরে থাকে। এসময়ে কখনও মহাকাশযাত্রা হতে পারে? অবাস্তব! যারা এটা জানে তাদের কথা বলতেও দেওয়া হয় না।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম সৌম্যর দিকে। এ তো পাগলের প্রলাপ নয়। তবুও বললাম, “অন্য কোনও কারণও তো থাকতে পারে। আমরা তো আর এ-ব্যাপারে এক্সপার্ট নই।”
“জানি তুই এত সহজে আমার কথা মেনে নিবি না। আচ্ছা, তোকে আরেকটা জিনিস দেখাই। শ্রীহরিকোটার কারেন্ট ওয়েদার। বলে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে শ্রীহরিকোটার ওয়েদার দেখানোর চেষ্টা করল সৌম্য। আমার কাছে খবর আছে যে ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে। আর ওই স্ক্রিনে দেখলি কীরকম ঝকমকে আকাশ দেখাল?” বলে সৌম্য ফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ওয়েদার রিপোর্টটা আমায় দেখায়।
তাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সানি স্কাই। টেম্পারেচার ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঠিক যেরকম দেখাচ্ছিল।
এবার চেঁচিয়ে ওঠে সৌম্য, “ওরা ওয়েদার রিপোর্টও চেঞ্জ করে দিয়েছে! কী সাংঘাতিক! মাই গড! এসব কী হচ্ছে! তুই বিশ্বাস কর দীপু, ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে।”
আমি ওর পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলাম। বলে উঠলাম, “সৌম্য, তুই বাড়ি যা। এসব নিয়ে মাথা খারাপ করিস না। এসব সাজিয়ে ওদের লাভ কী! তুই মনের মধ্যে থেকে এসব নেগেটিভিটি দূর কর। সব কিছুতেই প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু লজিক্যালি ভেবে দেখ। খুব সহজ ঘটনাকে শুধু শুধু জটিল করিস না।”
এবার সৌম্যর চোখে রাগ ফুটে উঠল। “তোদের কাছে লজিক শিখতে হবে, তাই না? ওই, ওই যে লোকটা, যে সায়েন্টিস্টের অভিনয় করছিল কিছুদিন আগে সাবানের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করত। চাপদাড়ি লাগিয়ে আর চোখের মণির কালার বদলে আমার চোখ এড়িয়ে যাবে, তাই না! এই কন্ট্রোল রুমের প্রত্যেকটা সায়েন্টিস্ট সাজানো! মাঝারি মানের অভিনেতা! বিজ্ঞানের কিছুই বোঝে না।”
আমি হেসে উঠলাম। “কেন, তোর ওদের উপরে এত রাগ কেন? চল, আমার বাড়ি চল।” বলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
ভিড় এড়িয়ে বেরোতে যাব, হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম! ঠিক রোহণের মতো দেখতে একটা ছেলে।
আকাশটা যেন একটু ধূসর হয়ে গেল। রোহণ যখন চলে যায়, তখন ওর চার বছর বয়স হয়েছিল। কোনও কথা না বলে সৌম্যর পিছু পিছু হাঁটতে থাকলাম। মিনিট কুড়ি হেঁটে চললাম। কথা নেই। চিৎকার চেঁচামেচি পিছনে ফেলে এসেছি। খানিকক্ষণ চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষে মনটা যেন হাল ছেড়ে অচেনা কোন দেশে হারিয়ে গেল। গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি। ফুরফুরে হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। দু’দিকে সাজানো বাগান। গাছের ফাঁক দিয়ে আধফালি চাঁদ। পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সব মিলিয়ে মাথা বেশ ফুরফুরে লাগছিল। সৌম্য গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলেছে। কথাগুলো কানে এল। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ
ক্ষণিকের তরে শুধু হাসিমুখ
পলকের পরে থাকে বুক ভরে
চিরজন্মের বেদনা
ওর গানের গলা বেশ ভালো। হঠাৎ গান থামিয়ে সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “তুই সত্যিই ভালো আছিস তো, দীপু?”
“হ্যাঁ, দিব্যি আছি। যেদিকে হাওয়া থাকে সেইদিকে কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে যাই। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে থাকি। কোনও পিছুটান নেই।”
শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সৌম্য। তারপর বলে উঠল, “শুধু তুই কেন, প্রায় সবাই ভালো আছে। কোনও দায়িত্ব নেই, কোনও ভাবনা নেই, খারাপ-ভালো বোধ নেই। সব খুইয়েই এখন আমরা শুধু সেই মুহূর্তের আনন্দে মেতে আছি। শেষ কবে দুঃখ পেয়েছিস, তা মনে পড়ে দীপু?”
মাথা নাড়লাম। সত্যিই মনে পড়ে না। সব সময় দিব্যি আনন্দে আছি।
“কেন জানিস? ভেবে দেখেছিস কারণটা? ওরা আমাদের কাঁদতে দেয় না। আমাদের মনও ওরা নিয়ন্ত্রণ করে। আয়নোস্ফিয়ারে বিশেষ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পাঠানো হয়। যা ফিরে এসে ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যে। আমাদের ব্রেনে আনন্দের সঞ্চার করে। দুঃখের দিনেও তাই আমরা দুঃখ পাই না। কাঁদতে আমরা তাই ভুলে গেছি। খুব কষ্টেও মুখের হাসি মোছে না। ওরা জানে যে আমরা চারপাশের কঠিন সত্যকে ভুলে থাকলে ওরা যা ইচ্ছে তাই করে যেতে পারবে। কোনও বিদ্রোহ হবে না। কেউ প্রশ্ন তুলবে না। ওরাও নিশ্চিন্তে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে আরও অপকর্ম করে যেতে পারবে। আমিও যদি তোদের মতো হতে পারতাম!”
খানিক থেমে আবার বলল, “কিন্তু পারলাম না। এই এটার জন্য।”
পকেট থেকে ছোটো বলের মতো কিছু একটা বার করল সৌম্য। তারপর বলল, “আমার আবিষ্কার। এটা চালু থাকলে সরকারি রেডিও ওয়েভের কোনও প্রভাব পড়ে না। তুই স্বাভাবিকভাবে ভাবতে পারবি। আর তখনই সত্যি ঘটনাগুলো তোর চোখে পড়বে। অসহায় মানুষগুলোর চিৎকার কানে আসবে। নিজের ফেলে আসা স্মৃতি ফিরে এসে মনের সঙ্গে কথা বলবে।”
বলে ছোটো বলটার উপর একটা জায়গা আলতোভাবে টিপল সৌম্য। একটা সবুজ আলোর আভা বলটা থেকে বেরোতে শুরু করল। হাতে নিলাম। হাল্কা গরম। ভিতরে কিছু একটা জিনিস খুব জোরে কাঁপছে।
“চল, ওই বেঞ্চটায় বসা যাক।”
খানিকদূরে একটা বেঞ্চ ছিল। দু’জনে সেখানে গিয়ে বসলাম। আমার হাতের বলটা থেকে অদ্ভুত সবুজ আভাটা এখনও বেরুচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকলাম ওটার দিকে। গঙ্গার ধারের এই বাগানটায় একসময় রোহণকে নিয়ে নিয়মিত আসতাম। কণাও থাকত সঙ্গে। এখানকার স্লিপগুলোতে বার বার চড়ত রোহণ। গাছগুলোর মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম ওর সঙ্গে। খানিকক্ষণ লুকোচুরি খেলার পর আমাকে খুঁজে পেলেই ছুটে এসে অভিমানী চোখে আমায় জড়িয়ে ধরত। বল নিয়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলতাম। রোহণ বলটাকে ধরতে পারলেই পরক্ষণেই ফেলে দিয়ে হাততালি দিয়ে উঠত আনন্দে। কী সুন্দর যে ছিল সেই দিনগুলো!
তারপর এল সেই দিন! স্কুলের গাড়ির মাতাল ড্রাইভারটার কাছে আসলে কোনও লাইসেন্সও ছিল না। ঘুষ দিয়ে নকল লাইসেন্স জোগাড় করেছিল। একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা মেরেছিল গাড়িটা। তিরিশটা বাচ্চার মধ্যে শুধু পাঁচজন বেঁচেছিল। রোহণ সে পাঁচজনের মধ্যে ছিল না। সে ড্রাইভারের কোনও শাস্তি হয়নি। শুনেছিলাম তার নাকি চেনাজানার মধ্যে কোন এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিল। ব্যস, সব দোষ মাফ।
সবকিছুর সুর কেটে গেল। যেন একটা চিল এসে হঠাৎ করে ছোঁ মেরে সব-সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেল! একটা মুহূর্ত, একটা খবর, ব্যস, তারপর সব শেষ। সময় যেন ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে গেল।
আমি মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে বসেছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। হাতে চোখের জলের স্পর্শ বুঝিয়ে দিল কাঁদছি। আমি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। নিজের এ কান্না আমি বহুদিন শুনিনি। মনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কথার যেন আমি হদিশ পাইনি। মনে হল একটা মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে গেছি। সামনে শুধু একটাই গাছ। তাতে একটাও পাতা নেই। মনে হল সে গাছ যেন আমারই মতো। বেঁচে থেকেও অস্তিত্বহীন।
চাঁদ হারানো এ সন্ধেয় যেন নিজেকে নিজের কাছে হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম। বেদনাও যে এত আপনার হতে পারে টের পেলাম। এ স্মৃতিতেই মিশে আছে আমার পরিচয়।
সৌম্য আমার পিঠে হাত দিয়ে বলে উঠল, “মন খারাপ করিস না, দীপু। বলটা দিয়ে দে, ফেরা যাক। সূর্যাস্তের শেষ রঙ ফের দেখতে পাবি। দেখ, ওদিকে তাকিয়ে দেখ। মনে হচ্ছে যেন কোনও এক শিল্পী তুলির টানে তোর মন ভালো করার চেষ্টা করছে। বারবার রঙ বদলে বদলে আরও ভালো করে আঁকার চেষ্টা করছে। এতে কিন্তু কোনও কারসাজি নেই।”