অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
সেই ছেলেটা যে কোনদিনই ছিল না
১
আমার ঠিক সামনেই সেই ছেলেটা যে নাকি কোনদিনই ছিল না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সামনের স্মৃতিফলকের দিকে। এও কী সম্ভব?
ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরের ওয়ার মেমোরিয়াল পার্ক। রোদ ঝলমলে দিন। তাই এই পার্কে খানিকক্ষণের জন্যে বেড়াতে এসেছি। বাড়ীর কাছেই। সেজন্যই হয়ত এখানে আগে আসা হয় নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গেছে, তাদের স্মৃতিতে শহরের মাঝেই এই সুবিশাল পার্ক। এছাড়া পার্কের মধ্যে খুব বড় একটা মেমোরিয়াল স্তম্ভ আছে।
বিশ্বযুদ্ধে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের প্রত্যেকের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এক একটা গাছ। সেই সৈনিকের নাম লেখা আছে গাছের নিচের স্মৃতিফলকে। বেশীরভাগই খুব কম বয়সে মারা গেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে অকালে ঝরে যাওয়া অনেক অসম্পূর্ণ জীবনের কথা।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে ঘাসের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র হলুদ ড্যাফোডিল ফুল। সবুজের মধ্যে হলুদের ভারী সুন্দর সমাহার। এ দেশে শীতের ঘুম ভাঙ্গার প্রথম লক্ষণ। পাহারাদারের মতো ঘিরে আছে একটা ছোট স্মৃতিফলককে। বলা যায় ড্যাফোডিল ফুলে যেন খানিকটা ঢাকাই পরে গেছে স্মৃতিফলকটা। একটা আড়াই ফুট উঁচু, দেড় ফুট চওড়া পাথরের উপরে লেখা মৃত সৈনিকের নাম।
স্মৃতিফলকের পিছনে একটা পত্রহীন রিক্ত বিশাল বারচ গাছ। যেন ছুটে চলা সময়ের হাত থেকে ফলকটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল গাছটার নিরাভরণ শাখাপ্রশাখার উপর নীল আকাশ নেমে এসেছে।
আমার মনে হচ্ছিল যেন দমবন্ধ হয়ে গেছে। এ কি দেখছি! মনে হচ্ছিল হঠাৎ করে কেউ যেন আমাকে টাইম মেশিনে করে চল্লিশ বছর পিছনে নিয়ে গেছে। আমার সামনেই ঠিক সেই ছবি যা ছোটবেলা থেকে বহুবার দেখেছি। সেই ফ্রেমে বাঁধানো হাতে আঁকা ছবি। কতবার দেখেছি সে সংখ্যা আমার জানা নেই।
একটু আগে থেকে শুরু করি। একটু আগে মানে চল্লিশ বছর আগে থেকে।
২
সাল ১৯৮০। তখন মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। লোডশেডিং ছিল, রেডিও -তে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল, টিভিতে একমাত্র চ্যানেল ছিল কলকাতা দূরদর্শন। সেই সময়ের কথা।
রায়ান আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল।
ভর্তির কয়েক মাস পরেও স্কুলে রায়ানের একমাত্র বন্ধু ছিলাম আমি। অবশ্য তার যথেষ্ট কারণও ছিল। একে তো ওকে দেখতে একটু সাহেবসুবোদের মতো ছিল, তাছাড়া এতো আস্তে আস্তে কথা বলত যে ওর প্রায় কোন কথাই শোনা যেত না।
হাসি ঠাট্টাতে সহজে যোগ দিত না। মনে হত যেন কিসের একটা ঘোরে হারিয়ে আছে। এমন কি ভবেশবাবুর মতো রাগী টীচার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে যখন আমরা সবাই মিলে পরের ক্লাসের আগে দু তিন মিনিট লাফালাফি করতাম, তখনও দেখতাম ও চুপ করে বসে বসে কী ভাবছে। দেখে মনে হত কোন কথা বলতেই যেন ওর কষ্ট হয়। মনে হত অন্য কোন গ্রহের জীব। ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে।
যদিও ওর আসল নাম ছিল রায়ান, আমরা সবাই ওকে ‘রায়’ বলেই বলতাম। । অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। শুনেছিলাম ওর বাবা ইংরেজ, মা ভারতীয়। দেখেই সেটা বোঝা যেত। চোখের মনির রঙ ছিল অপরাজিত ফুলের মতো নীল। গায়ের রঙ খুব ফরসা না হলেও আমাদের থেকে অনেক পরিষ্কার।
সকালে আমার পাশে এসে বসে শুধু আমাকে বলত- গুড মরনিং। কেমন আছিস?
আমি হয়ত বললাম -ভালো। তুই? কাল ভারত- ইংল্যান্ডের ক্রিকেট টেস্টম্যাচটা দেখলি? কী ভালো হল, তাই না? আরেকটু হলে গাভাস্কার ঠিক জিতিয়ে দিত। একটুর জন্য হেরে গেলাম।
ও এসব কথায় যোগ না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ত।
এরপর আর কথা বলা যায়?
আমাদের স্কুল শেষ হত চারটের সময়। মধ্য কলকাতার নামী ইংরাজি মাধ্যম স্কুল। বহু পুরনো স্কুল। আমরা সবাই স্কুলের পরে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলতাম। দেখতাম ও বাড়ী যেত না। মাঠের পাশে এসে চুপ করে বসে খেলা দেখত। কিন্তু চোখে মুখে কি যেন বিষণ্ণতা। ডাকলেও খেলতে আসত না। মনে হত যেন ও এক অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। মাঠের পাশে বসে থাকলেও ওর সঙ্গে আমাদের সত্যিকারের দূরত্ব যেন তার থেকে অনেক বেশী।
ক্লাসে সব সময় আমার পাশে বসত। তাই দেখতে পেতাম ইতিহাসের ক্লাসে খাতা বার করে কিসব হিজিবিজি কাটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পড়ানো হচ্ছে, ও কিছু না শুনে পাতায় কি সব হিজিবিজি লিখে যাচ্ছে। এসব করলে যা হয় আর কি! মাঝে মধ্যেই ক্লাসে পড়া না পারার জন্য বেঞ্ছির উপরে বা ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। ওর তাতে কোনরকম লজ্জা হত বলে মনে হত না।
শুধু ইংরেজিটা খুব ভালো জানত। ওটাতে সবার থেকে বেশী নাম্বার পেত। বাংলা আর ইংরাজি মিশিয়ে সব সময় কথা বলত। মনে হত বাড়ীতে ইংরাজিতেই বেশী কথা বলে। এছাড়া ও ছবি খুব ভালো আঁকত। টিফিন পিরিয়ডে চুপচাপ বসে ছবি এঁকে যেত। ওর খাতা ভরা থাকত ছবিতে। অবাক হয়ে দেখতাম। শুধু ভালো আঁকার জন্য নয়। সে সব ছবি যেন কোন অচেনা দেশের, কোন অচেনা সময়ের। পাহাড়ের ছবি। সবুজে ঢাকা উপত্যকার ছবি। রাস্তার পাশ দিয়ে কাঠের বাড়ী, পাইন গাছের ছবি। বুঝতে পারতাম ও কোন বিদেশী বই থেকে দেখে আঁকে।
আমি মামাবাড়ীতে মানুষ। মা খুব কম বয়সে মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। তারপর থেকে আমি মামাবাড়ীতেই বড় হই। স্কুলে পড়ার সময় মাকে আর বাবাকে খুব মিস করতাম। অনেক সময় আমিও আমার স্বপ্ন রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মনের মধ্যে পাওয়া না পাওয়া জগতের জিগস পাজল জুড়ে জুড়ে স্বপ্ন তৈরি করতাম।
মাঝে মধ্যে মনে হত রায়ানের সঙ্গে কোথায় যেন আমার মিল আছে। সেজন্যই হয়ত আমরা দুজনে দুজনকে বুঝতে পারতাম। কিছুদিনের মধ্যে আমরা খুব বন্ধু হয়ে গেলাম।
স্কুলের লাইব্রেরীতে খুব কম ছেলেই নিয়মিত যেত। আমি আর রায়ান নিয়মিত যেতাম। ভালো বই কিছু পড়লে ওকে বলতাম, ও আবার কিছু ভালো বই পড়লে আমাকে সাজেস্ট করত।
কিন্তু ক্লাসে সেই একই রকম অন্যমনস্ক থাকত।
আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – রায়, তুই মন দিয়ে কিছু শুনিস না কেন? শুধু শুধু এতো শাস্তি পাস।
-আই কান্ট ফলো দেম। এ লট অফ ব্যাক গ্রাউন্ড নয়েস। যেন সবাই সবসময় ফিসফিস করছে। টীচার কি বলছে কিছুই বুঝতে পারি না। আমি শুধু তোর কথা বুঝতে পারি।
- সে কি? তুই ডাক্তার দেখাস নি? হয়ত কানে কোন কিছু হয়েছে। আমার দিদারও এরকম হয়।
ও আর কিছু বলে নি।
ও আমার সঙ্গেও খুব বেশী কথা বলত না। কিন্তু তাও যেটুকু বলত, তা শুধু আমার সঙ্গেই। লক্ষ্য করতাম ও আমাকে ছাড়া আর সবাইকে এড়িয়ে চলে। বলতে নেই আমার বেশ ভালোই লাগত সেটা।
কিছুদিন বাদে ওকে একদিন আমার বাড়ী নিয়ে এলাম। আমার বাড়ী মানে মামাবাড়ী। বড়মামার কাছ থেকে দাবা খেলতে শিখেছিলাম। ওকে শিখিয়ে দিলাম। আমার থেকে শিখে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ও বেশ ভালো খেলতে শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে এমন হল যে প্রায় নিয়মিতই ওর কাছে হারতাম। আসলে ওর বুদ্ধি বেশ ভালই ছিল।
মাঝে মধ্যেই স্কুল ফেরত আমি ওকে বাড়ী নিয়ে আসতাম। দিদিমার ঘরে মেঝের উপরে বসে দাবা খেলতাম। দিদিমা ওকে খুব ভালবাসতেন। এলেই কুলের আচার, নারকোলের নাড়ু, এসব দিতেন । ও এসব খেতে খুব ভালোবাসত। এমন ভাবে খেত যেন ওকে কেউ কোনদিন এসব খাবার খেতে দেয় নি।
দেখতে দেখতে এভাবে আমরা ক্লাস সেভেনে চলে এলাম। আমি খুব ভালো রেজাল্ট করলেও ও কোনরকমে পাস করেছিল।
একদিন হঠাৎ সুদীপ্ত আমাকে একটা কথা বলল। রায়ানকে নিয়ে। তখন রায়ান কাছাকাছি ছিল না।
ও বলে উঠল – আচ্ছা, তুই তো রায়ের খুব বন্ধু। তোর রায়কে খুব অদ্ভুত মনে হয় না।
আমি একটু অবাক হলাম। হঠাৎ করে এরকম প্রশ্ন।
ও ফের বলে উঠল – ওর বাড়ী গিয়েছিস কখনও?
-না, কেন তুই গিয়েছিস?
-না, আমি ভেবেছিলাম তোকে অন্তত কোনদিন নিয়ে গেছে। এতো বন্ধুত্ব তোদের।
-না, কিন্তু কেন বল তো?
-আমাদের সবার বাড়ী থেকে কেউ না কেউ অনেকদিন স্কুলে আসে। খোঁজ খবর করে। টিচারদের সঙ্গে দেখা করে। স্পোর্টসের দিন আসে। ওর কাউকে কোনদিন আসতে দেখেছিস?
-না। কিন্তু তাতে ও কি করবে? অবাক হওয়ার কি আছে?
সুদীপ্ত একটু বেশী সন্দেহবাতিক। ফের বলে উঠল। এবার একটু কাছে এসে।
-আমি সেদিন ওকে পার্কস্ট্রীটের কবরখানায় দেখেছি। আমি পিসির বাড়ী গিয়েছিলাম। ওরা ঠিক কবরখানার পাশেই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। তখন রাত ন’টা হবে। ওটা বন্ধ হয়ে যায় ছ’টা নাগাদ কিন্তু কি দেখলাম জানিস?- বলে ও চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে রহস্যজনকভাবে তাকাল।
-কি?
-রায় ওর মধ্যে ঘুরছিল। তারপরে একটা ভাঙ্গা মার্বেলের সমাধির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে আবার আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলো।
-তুই অন্ধকারে ঠিক দেখেছিলি?
-হ্যা, একদম। দূর থেকে হলেও স্পষ্ট দেখেছি। ওখানে আলো ছিল। আমার চিনতে ভুল হয় নি। তোর তো খুব বন্ধু। ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখিস গিয়েছিল কিনা!
- কিন্তু সে তো যেতেই পারে! হয়ত ওর কোন আত্মীয়ের সমাধি আছে।
-তা বলে অত রাতে? ওরকম জায়গায় তুই পারবি একা যেতে? ঢুকলই বা কোথা থেকে কে জানে?
-নির্ঘাৎ ঢোকার অন্য কোন পথ আছে।
সুদীপ্ত মাথা নেড়ে বলেছিল- তাই হবে হয়ত।
আমি পরে রায়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর না দিয়ে কিরকম যেন উদাসী চোখে তাকিয়েছিল। যেন ওই জায়গাটাই ও চেনে না।
তবে আমার ওর উপরে খানিকটা অভিমান হয়েছিল। আমার বাড়ীতে ও অনেক দিন এসেছে। কিন্তু আমাকে কোনদিন ও ওর বাড়ীতে যেতে বলে নি। হতে পারে ওরা অনেক বড়লোক। কিন্তু কোনদিন কি আমাকে ওর বাড়ীতে ডাকতে পারত না! ও কোনদিন বাসে যায় না। স্কুল থেকে হেঁটে যায়। নিশ্চয়ই বাড়ী খুব বেশী দূরে নয়। আমার মামাবাড়ী সেখানে অনেকটা দূর। কিন্তু তা সত্বেও ও কত দিন এসেছে। আমি বলি বলেই না এসেছে!
ও না বললেও কয়েক মাস বাদে সে সুযোগ এসে গেল একদিন।
আমার ছোট পিসির ফ্ল্যাট ছিল ময়দানের কাছে। রাসেল স্ট্রীটে। অনেকদিন যাই নি।। পিসেমশাই ব্যাংকের খুব বড় অফিসার। সেদিন ছিল রোববার। পিসির বাড়ীতে সারাদিন দারুণ খাওয়াদাওয়া হল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সন্ধের দিকে বেরোলাম বাড়ী ফিরব বলে। তখনো কলকাতায় মেট্রো চালু হয় নি। খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাসস্টপ।
ভেবেছিলাম নিজে নিজে পথ চিনে বাসস্টপ খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু ভুল করলাম। বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অলিগলি দিয়ে যেতে গিয়ে খানিকবাদেই পথ হারালাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পথে একটা পার্ক পড়ল। শহরের এই দিকটার সঙ্গে আমার একদম পরিচয় না থাকায় ঘুরপাক খাচ্ছি, কি করব ভাবছি, হঠাৎ মনে হল কিছু দূরে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে।
খুব পরিচিত হাঁটা। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম এটা রায়ান । চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম। প্রথমে সাড়া দিল না। তারপর দ্বিতীয়বার ডাকার পর ঘুরে তাকাল। আমাকে দেখে চমকে উঠল। তারপর আনন্দে ছুটে এগিয়ে এলো।
-তুই এখানে?
-আমার পিসীর বাড়ী এখানে। কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?
ওর হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ছিল। সেটা ডান হাত তুলে দেখিয়ে বলে উঠল- কিছু জিনিষ কিনতে গিয়েছিলাম। আমি তো এখানেই থাকি। একদম কাছে। হান্ড্রেড ইয়ারডস ফ্রম হিয়ার।
-দারুণ । চল , তোর বাড়ী দেখে আসি। ওখানে গিয়ে গল্প করে তারপরে খনিকবাদে বেরবো।
- এতো রাতে? তোর ফিরতে আসুবিধে হবে না?
-না, ঠিক কিছু একটা পাওয়া যাবে।
ও যেন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপরে বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে বলে উঠল- তবে চল। বাট ইট মাইট গেট টু লেট ফর ইউ।
ওর সঙ্গে সঙ্গে এগোলাম। এটা মধ্যকলকাতার বেশ উচ্চবিত্তদের এলাকা। উত্তর কলকাতার মতো গায়ে গায়ে বাড়ী নেই। বেশীর ভাগই ফ্ল্যাট এ এলাকায়। মাঝে মধ্যে বিশাল জায়গা জুড়ে দেওয়াল ঘেরা সামান্য কিছু বাড়ী।
সেরকমই একটা বাড়ীর সামনে এসে আমরা এসে দাঁড়ালাম। বেশ বড় বাড়ী। বাইরের বড় গেট ঠেলতেই খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকতেই অবাক হলাম।
মধ্য কলকাতায় প্রায় শহরে কেন্দ্রে এরকম বাড়ীও হয়? একটা সময় বেশ বড় বাড়ী ছিল। এখন সামনে খানিকটা খোলা চাতাল। অযত্নে বেড়ে ওঠা অজস্র আগাছায় ভরা একটা বাগান। বাগানের এক কোনে একটা নিম গাছ। তারপরে একটা দোতলা বাড়ীর ধবংসস্তুপ।
মনে হচ্ছে বাড়ীর শুধু ইটের শিরদাঁড়াটুকুই টিঁকে রয়েছে। দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অশ্বত্থ গাছের শিরা উপশিরা গজিয়েছে। চারধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে বারান্দা পরে তার বাঁদিকের অংশ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা ইটের দাঁত বেরিয়ে আছে সর্বত্র।
বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছিল। কিন্তু তবু বাড়ীর ভিতরে কোন আলো জ্বলছিল না। মনে হচ্ছিল এ পোড়ো বাড়ীতে সাপ না থাকলেই অবাক হব।
ও আমাকে সামনের একটা ঘরে এনে বসাল। বেশ বড় ঘর। এ ঘরে সামান্য কিছু ভাঙ্গা আসবাব ছড়িয়ে আছে। একদিকে একসময় বড় ফায়ার প্লেস ছিল। এখন সেখানে কিছু ইট পরপর সাজিয়ে রাখা রয়েছে।
ঘরের দেয়াল জুড়ে দামী কাঠের কাজ। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় তা ভেঙ্গে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। মাটির উপরে এককোণে কালো টিনের তোরঙ্গ পরে আছে। ঘরে বেশ কয়েকটা বড় বড় খড়খড়ির জানলা। কিন্তু সেসব জানলার বেশীর ভাগ কাঠই ভাঙ্গা। ঘরের মাঝবরাবর বাহারী রঙ্গিন কাঁচের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। সেটা দিয়ে বাগানটা দেখা যায়। কিন্তু তারও একটা বড় অংশ ভেঙ্গে গেছে।
আমি নিশ্চিত এখানে চোরে ঢুকতেও ভয় পাবে।
-তুই এখানে থাকিস?
-হ্যা।
বুঝতে পারলাম। এজন্যই ও হয়ত আমাকে এখানে আসতে বলে নি। হয়ত বড় কোন অসুবিধে হয়েছে ওদের। আগে হয়ত খুব ভালো অবস্থা ছিল। আমার মামাবাড়ীরও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা ভালো না। কিন্তু সেটাও এ তুলনায় অনেক ভালো।
-তোর বাবা – মা কোথায়?
-ওরা ভেতরে অন্য ঘরে আছে।
একটু অবাক হলাম। কারণ ভিতরে কোন আলো জ্বললে এখান থেকে তার আভাস পাওয়ার কথা। ভেতরের দিকে তাকালে শুধুই কালিঢালা অন্ধকার।
আমাকে একটা পা নড়বড়ে বিশাল কাঠের কাজ করা চেয়ারে বসতে বলে ও আরেকটা ভাঙ্গা চেয়ার নিয়ে সামনে এসে বসল। আমরা নানান বিষয়ে গল্প শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই মনে হল কী যেন একটা অন্যরকম হচ্ছে। ওর কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। যেন খুব কাছেই আরও অনেকে কথা বলছে। কিরকম যেন ফিসফিসিয়ে। অনেকে থাকলে যেমন হয় সেরকম আর কি! ওর কথাও মাঝে মধ্যে তার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল।
তার মাঝে মধ্যে যেন কাপ-ডিশের আওয়াজ। বহু দূর থেকে ভেসে আসা কিছু কথা। তারপর আবার সব চুপচাপ। আবার যেন কেউ ছুটে বেড়াচ্ছে ঘরে। ছোটরা যেভাবে ছুটে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে যেন পোড়া মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। যেন কিছু রান্না হচ্ছে।
এদিক ওদিক দেখে বললাম, এ বাড়ীতে কি আরও অনেকে আছে?
না, না আমি, বাবা আর মা-ই থাকি।
ওর মধ্যে শুরুর দিকে একটা জড়তা ছিল। আস্তে আস্তে সেটা কেটে গেল। ও অন্য একটা ঘর থেকে দাবার বোর্ড নিয়ে এলো। আমরা খেলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে অন্ধকার আরেকটু বাড়তে ও একটা আজব চেহারার বড় হ্যারিকেন নিয়ে এলো। তার আলো বেশ জোরালো। আমরা সে আলোয় খেলতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে হল ভিতরের ঘর থেকে কেউ যেন জোরে জোরে কথা বলছে। কিন্তু আগের মতোই কোন কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সেটা বাংলা না ইংরাজিতে বলছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। শুদু মনে হচ্ছে যেন একাধিক লোক –উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। নারী পুরুষের গলা তার মধ্যে মিশে আছে।
রায়ান একটু যেন বিব্রত হয়ে আমাকে বলে উঠল,- দাঁড়া একটু ভেতর থেকে ঘুরে আসছি। আই উইল বি ব্যাক ইন মিনিটস।
ও ভেতরের ঘরে চলে গেল। আর তখনই যেন বাকি শব্দের চরিত্র আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম। কেউ যেন দূরে পিয়ানো বাজাচ্ছে। কোথাও যেন পার্টি হচ্ছে। কাঁচের গ্লাসে গ্লাসে ধাক্কা লাগার টুং- টাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে যেদিকে রায়ান গেলো, সেদিকে একবার উঁকি মারলাম।
অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোন আলো জ্বলছে না। কি মনে হল, দেওয়ালে হাত রেখে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিল সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এ দেওয়াল যেন বরফ শীতল, ভিজে ভিজে। পায়ের তলার মেঝে এবড়ো খেবড়ো, নানান জায়গায় ভাঙ্গা।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজটা দিয়ে ফুট তিনেক যেতেই বুঝলাম আর এগোনো প্রায় অসম্ভব। হ্যারিকেনের আলো আর সামনে যাচ্ছে না। কিন্তু স্পষ্ট ওই আওয়াজটা ভেসে আসছে। ঠিক এমনসময় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া যেন আমাকে ধাক্কা মেরে গেলো। হঠাৎ করে একটা স্ট্যান্ডিং ফ্যানের সামনে গিয়ে পড়লে যেরকম হয়। চমকে উঠে পড়ে যাচ্ছিলাম।
কোনরকমে সামলে নিলাম। তারপরে হাতড়ে হাতড়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। মনে হল একটা বড় ডাইনিং রুমে এসে পড়েছি।।
ঘরের মধ্যে অন্ধকার থাকলেও একপাশের বড় কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের আলো সামান্য এসে পড়েছে। সে আলোয় বুঝতে পারলাম যে ঘরটায় এসে পড়েছি, সেরকম বড় ঘর আমি আগে কখনও দেখি নি। ঘরের মাঝ বরাবর একটা বিশাল ডিম্বাকৃতির ডাইনিং টেবল। কাঠের কাজ করা। প্রায় পনেরোটা চেয়ার রাখা বিশাল টেবিলটাকে ঘিরে।
হঠাৎ হার্ট বিট যেন বন্ধ হয়ে গেলো।
এর মধ্যে কয়েকটা চেয়ার ফাঁকা নেই। সেখানে লোক বসে আছে। যারা বসে আছে, তাদের সবার দৃষ্টি আমার দিকে। একজন বিশালদেহী সাহেব। সুট -টাই পরা, নীল চোখে আমার দিকে কড়াভাবে তাকিয়ে আছে। পাশে নীল গাউনপরা এক বছর চল্লিশের মহিলা। ইনি ভারতীয়। কালো চুল। যেন আমার মায়ের মতো দেখতে। অন্য দুটো চেয়ারে দুটো আঁট -নয় বছরের বাচ্চা। উপরে বড় একটা ঝাড় লন্ঠন । কিন্তু কোন আলো জ্বলছে না।
ঘরে অন্ধকারের মধ্যে মিশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনজন। না , তিনজন নয়। চারজন। তার মধ্যে তিনজন ভারতীয় । দেখে মনে হচ্ছে কাজের লোক। একজন হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আরেকজন ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ মহিলা। মনে হয় বাড়ীর হাউসকীপার। সাদা গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ঘরে কোন আলো নেই। চেয়ারেও সবাই যেন স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। যেন সময়ের একটা মুহূর্তে আটকে আছে।
ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আবার সাহেবের দিকে তাকালাম। এখনও আমার দিকে একই ভাবে তাকিয়ে আছে। মুখ যেন রাগে লাল হয়ে গেছে।
কে যেন হঠাৎ আমার হাত এসে ধরল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রায়ান। হাত ধরে আবার আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো আগের ঘরে।
ওর ফরসা মুখ যেন একটু লাল হয়ে গেছে। আমাকে বলে উঠল- তুই কোথায় যাচ্ছিলি! ইউ শুডন্ট হ্যাভ লেফট দিস রুম। আমার বাবা একটু রাগী মানুষ। তাছাড়া ভারতীয়দের ভালো চোখে দেখেন না।
-কিন্তু কেন?
-সে জানি না। তোর আর এখানে থাকা উচিত হবে না। রাতও হয়েছে।
সত্যি রাত হয়ে গিয়েছিল। বাড়ীর মধ্যে কোথা থেকে গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের গম্ভীর গলায় আটটা ঘণ্টার শব্দ ভেসে আলো। যেন সেও আমাকে অবিলম্বে চলে যেতে বলছে। আমি উঠে পড়লাম। রায়ান আমার হাত ধরে বাগান পেরিয়ে গেট অব্দি এলো। বাইরে রাস্তার আলো জ্বলছিল।
বেরোনোর সময় দেখলাম, তখনও বাড়ীর অন্য কোন ঘরে আলো জ্বলছে না। এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে আমার চোখ যেন আরও বেশী করে সব কিছু দেখতে পাচ্ছিল। রাস্তায় এসে পড়লাম।
সেদিন মামাবাড়ীর ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। বাড়ীতে বেশ বকুনি খেয়েছিলাম। আসলে সে সময় মোবাইল ফোন ছিল না যে ইচ্ছে করলেই জানিয়ে দেওয়া যাবে। না জানিয়ে অত রাতে ফেরায় বাড়ীর সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।
এর দুদিন বাদের কথা। অঙ্কের ক্লাস ছিল শেষে। ও আমাকে আগেই বলে রেখেছিল স্কুল শেষ হওয়ার পরে একটু থাকতে। স্কুল শেষ হতে আমাকে ওর ব্যাগ থেকে একটা ছোট ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বার করে দিল।
বলে উঠল – এটা তোকে দিলাম। ইউ আর মাই বেসট ফ্রেন্ড। তোকে দেওয়ার জন্য এটা আমি এঁকেছি।
ছবিটা দেখে অবাক হলাম। হেসে উঠে বলে উঠলাম – খুব সুন্দর। এ আবার কোন জায়গার? কি ফুল এটা?
আসলে সে ছবিতে ছিল একটা পাথরের স্মৃতি ফলক। তার পিছনে একটা অচেনা বড় গাছ। সে গাছে কোন পাতা নেই। তাকে ঘিরে ঘাসের মধ্যে ফুটে আছে অনেক হলুদ ফুল। ড্যাফোডিল। তখন অবশ্য ওই ফুলের নাম জানতাম না। আমি সেরকম আগে দেখিও নি। জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল ড্যাফোডিল। ওর ফেভারিট ফুল। ইংল্যান্ডে নাকি অনেক ওই ফুল ফোটে।
ওর আঁকার হাত চিরকালই খুব ভালো ছিল। ওই স্মৃতিফলকের অংশটা বাদ দিলে ছবিটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – কিন্তু এখন তো আমার জন্মদিন নয়। হঠাৎ করে এরকম গিফট?
ও হেসেছিল। তার পরে বলেছিল- সো দ্যাট ইউ ক্যান রেকগনাইজ মি। চিনতে পারিস।
-ধুর, তোকে আমি কোনদিন ভুলে যাব নাকি! সম্ভবই নয়। তাছাড়া তুই তো আর স্কুল ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস না।
একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ও বলেছিল- হয়ত, আমাকে যুদ্ধে যেতে হল। হঠাৎ করে স্কুল ছেড়ে। আর ফিরে এলাম না। তখন?
-এখন, যুদ্ধ?
তখন হাসলেও, এর পরের দিন ও স্কুলে আসে নি। তার পরের দিনও না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওর বোধহয় জ্বর হয়েছে।
কয়েকদিন আসছে না দেখে আমি ওই পাড়াতে গিয়েছিলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে বাড়ীটা পেলাম। তখন বিকেল চারটে। বাইরে দিনের আলো তখনও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সেদিনকার মতো গেটটা ভেজানো নেই। ভেতর থেকে তালা বন্ধ। একটা নয়, বেশ কয়েকটা বড়োসড়ো তালা। গেটের ফাঁক দিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হল না কেউ এখানে থাকে। এমন কি কেউ কোনদিন এখানে ছিল বলেও মনে হল না।
প্রথমদিন আধোঅন্ধকারে যেটুকু পরিচয় পাই নি, সেটা সেদিন ভালো করে পেলাম। একটা আগাছায় ভরা বাগান, তারপরে একটা সম্পূর্ণ পোড়ো বাড়ী, যেখানে গত দশ বছরে কেউ থেকে থাকলেই অবাক হব।
দিনের বেলাতেই কিরকম যেন গা ছমছম করছে।
রাস্তার উল্টোদিকে একটা বেশ বড় গাড়ীবারান্দাওয়ালা আধুনিক বাড়ী। তার গেটে বেশ একজন জাঁদরেল উর্দিপরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সাহস করে তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। রায়ানকে এখান থেকে বেরোতে দেখেছে কিনা।
সে বেশ অবাক হয়ে বলে উঠল – না, ঊখানে তো কেউ কুনোদিন থাকে না। আমি কাউকে ঢুকতে বেরোতে কোনদিন দিখি নাই।
আমি ফের বলে উঠলাম- আমার বন্ধু ওখানে থাকে। তিনদিন আগেও এসেছি।
আমাদের কথাবার্তা শুনে ইতিমধ্যে ভেতর থেকে দেখি এক চশমা পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছেন। মনে হল উনি এ বাড়ীর মালিক। আমাদের কথোপকথন শুনেছেন।
আমাকে একটু অবাঙ্গালীটানে বাংলায় বলে উঠলেন - এ তো এ পাড়ার একমাত্র পোড়ো বাড়ী। আমি কুড়িবছর এখানে আছি। কাউকে কোনদিন দেখি নি। শুনেছি এক সময় বেনেট ফ্যামিলি থাকত এখানে। সাহেব নাকি বেজায় ভারতীয় বিদ্বেষী ছিল। একবার এ বাড়ীতে স্বাধীনতার আগে হামলাও হয়েছিল। ম্যাথু বেনেট হাইকোর্টে জাজ ছিলেন। একমাত্র ছেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা যায়। পরে সাহেব আর মেমসাহেব দুজনেই এখানেই মারা যায়। বহুবছর কেউ থাকে না এ বাড়ীতে। কিছু লিগাল গণ্ডগোলের জন্য বাড়ীও বিক্রি হয় নি।
-সে কি করে হয়? আমার বন্ধু এখনও ওখানেই থাকে।
লোকটা এবার হেসে উঠল। বলে উঠল- তোমার বন্ধু তাহলে মানুষ নয়, ভূত হবে।
শুনেই গা কিরকম ছমছম করে উঠল। আমি আর কথা না বলে সোজা বাড়ী ফিরে এলাম। এরপরে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম রায়ানের। ভেবেছিলাম আবার হয়ত ফিরে আসবে। মনে হয় সেদিন ইচ্ছে করে আমাকে ভুল বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত কোন কারণে ও ওর বাড়ীতে আমাকে নিয়ে যেতে চায় নি। ওই বাড়ীর গেট খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছিল। এ ছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে!
কিন্তু না আর কোনদিন ওর দেখা পাই নি। ও আর কোনদিন স্কুলে আসে নি।
আসল অবাক হলাম এর কিছুদিন পরে। ওর কথা অন্য কেউ জানে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে। ক্লাসে যতজন ছিল, তারা কেউ নাকি ওকে কোনদিন দেখে নি। বারবার করে ওর চেহারা, কথা বলার ধরণ বলার পরেও কেউ ওর কথা খেয়াল করতে পারল না। উলটে বলে কিনা আমার মাথা খারাপ।
কি আশ্চর্য। সবাই কিভাবে ওকে ভুলে যেতে পারে! সবাই আমার সঙ্গে মজা করার জন্য মিথ্যে বলছিল কিনা কে জানে!
বাধ্য হয়ে কয়েকজন টীচারকেও জিজ্ঞেস করলাম। না কেউ ওকে কোনদিন দেখে নি। নামও শোনে নি। ওই নামের কোন ছেলে নাকি কোনদিন স্কুলে পড়ে নি। বললাম যে ও অনেক সময় ক্লাসে বেঞ্ছির উপরে দাঁড়িয়ে থাকত। বাইরে নীল ডাউন হয়ে বসার শাস্তি পেত। কিন্তু শুনলাম সেরকম শাস্তি নাকি আমি নিজেই বেশী পেয়েছি।
বেশ বুঝতে পারছিলাম প্রশ্ন শুনে আমি স্বাভাবিক আছি কিনা, সেটাই সবাই সন্দেহ করছে।
সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম সেদিনের কথাটা। ও তো আমাকে রায়ান সম্বন্ধে বলেছিল।
ও শুনে অবাক হয়ে বলে উঠল- এজন্যই তুই এতো অন্যমনস্ক থাকতিস। নিজের মনে যেন মাঝে মধ্যে বিড়বিড় করতিস। আমি আবার কবে বললাম যে আমি কাউকে পার্ক স্ট্রীটের কবরখানায় দেখেছি। সে তো তুই বললি যে তুই নাকি একটা ছেলেকে ওখানে দেখেছিস। সে নাকি আবার তোর খুব বন্ধু হয়।
আর কথা বাড়ালাম না ওর সঙ্গে।
শেষ ভরসা দিদিমা। দিদিমা ওকে কতো ভালবাসতেন। আমরা দিদিমার সামনেই খেলতাম। সেটা উনি মন দিয়ে দেখতেন। কিন্তু এবারেও জিজ্ঞেস করে অবাক হলাম। দিদিমা বললেন আমি নাকি একা দাবা খেলতে খেলতে বিড় বিড় করে কথা বলি। দুজনের চাল দিই।
আর কুলের আচার আর নারকেল নাড়ু? সে নাকি আমিই খেয়েছি।
এর পরে আর কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। এ যেন একটা স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নটা আমার কাছে আমার জীবনের থেকেও জীবন্ত। আমার ছেলেবেলার একটা খুব বড় অংশ। ওর উপস্থিতি আর কারুর কাছে ধরা না পড়লেও আমার কাছে যে সেটা সত্যি ছিল, সেটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ হয় নি। ওর মতো আর কোন বন্ধুও হয় নি। এতো বছর বাদে অনেক কিছু ভুলে গেলেও ওর সব কথা তাই স্পষ্ট মনে আছে।
৩
কতো বছর কেটে গেছে। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম রায়ানের কথা। আমি এখন ইংল্যান্ডে থাকি। মাঝে প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। সেই ছবিটাও হারিয়ে গেছে। তবে মন থেকে যে সে ছবিটা হারায় নি, সেটা টের পেলাম এতো বছর বাদে।
সামনে ঠিক সেই ছবি। সেই রকম ড্যাফোডিল ঘেরা বারচ গাছ। তার নিচে সেই স্মৃতি ফলক।
তাতে লেখা,
ইন মেমারি অফ,
রায়ান বেনেট
রয়্যাল ওয়ার উইকশায়ার রেজিমেন্ট
কিলড ইন অ্যাকশন, থার্ড মার্চ ১৯৪৫
আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমার ছোটবেলার বন্ধুর সামনে। এ রায়ান আমার বন্ধু রায়ান ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।
আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম- আই রেকগনাইজ ইউ রায়ান। আমি সবসময়ই জানতাম যে তুমি ছিলে। আমি তোমাকে আজও ভুলি নি। ভালো থেকো বন্ধু।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
ওয়ারউইক, ইংল্যান্ড