অভিজ্ঞান
রায়চৌধুরী
ছেলেবেলার পুজোর
দিনগুলো সত্যি অন্যরকম ছিল। আমি সত্তরের দশক ও আশির দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি।
সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম ওই ক’দিনের। তখন
মোবাইল ফোন ছিল না। ইচ্ছে হলো আর ফোন করে
আরেকজনের সঙ্গে কথা বলব, সেরকম উপায় ছিল না।
তখনকার সোশ্যাল নেটওয়ারকের অর্থ ছিল ওই
ক’দিনের নির্ভেজাল আড্ডা। বাড়ীর সব নিয়ন্ত্রণরেখাগুলো যেন ওই কদিনের জন্য শিথিল
করে দেওয়া হত। ওই উৎসবের দিনগুলো ছিল আত্মীয়- দূরাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার সময়, নিয়ম
ভাঙ্গার দিন। যে যেখানেই থাকুক না কেন ওই সময় ঠিক কলকাতায় চলে আসত।
আমি ছোটবেলা থেকেই খুব কল্পনা প্রবণ ছিলাম।
একটা বড় সময় থাকতাম নিজের কল্পনার জগতে যেখান গল্প প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়, কখনও
আমাকে নিয়েই হারিয়ে যায়। পুজোর সময়ে সে কল্পনার জগতে আরও রসদ মিলত। সমাজের এমন
একটা অংশকে কাছ থেকে দেখতে পারতাম, যাদের সঙ্গে অন্য সময়ে অত সহজে মেশা যেত
না।
আমাদের বাড়ীর প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পুরনো পারিবারিক পুজো হত খুলনার
খলসেখালিতে। সেখান থেকে দেশভাগের পরে সেটা চলে আসে হাড়োয়ার হরিপুরে। ছোটবেলায়
ওখানে পুজোর সময়ে দুদিন যেতাম। কলকাতা থেকে বাসে করে যেতাম। একদিকেই প্রায় ঘণ্টা
তিনেক। কষ্ট হলেও আনন্দ হত বহুগুণ বেশী।
পুজো উপলক্ষে বেশ কয়েকটা গ্রাম মিলিয়ে বেশ বড় মেলা বসত। বেশ বড় মণ্ডপে
আটচালার পুজো হত। তার সামনেই কিছু দূরে বসত মেলা। বেলুন, প্লাস্টিকের বন্দুক, আরও
কত কি। আমার পুজোতে কোন আগ্রহ ছিল না। আমার
আগ্রহ ছিল মেলায়, পুজোর জন্য যারা আসত গ্রামের সে সব মানুষে। মিশে যেতাম গ্রামের সমবয়সীদের
ভিড়ে।
অনেক সময় মাঠ, খেত- আল পেরিয়ে অনেক দূরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম।
আমাদের ওখানে পুজোর জন্য একটা পাকা বাড়ী ছিল।
সেখানে অবশ্য ছিল শুধু বড়দের আড্ডা। পুজোর সব আয়োজন, খাবার দাবারের ব্যবস্থা সেখান
থেকে হত। শুধু খাওয়ার ডাক এলে ওখানে যেতাম। বাকি সময় বাইরেই থাকতাম।
সে পুজো অবশ্য পরে বন্ধ হয়ে যায় কিছু সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের কারণে। ছোট
ছিলাম তাই মনের মধ্যে যাতে বিদ্বেষের দেওয়াল না গড়ে ওঠে, সেজন্য কখনও বাবা- মা এ
বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে নি। পরে বড় হয়ে জেনেছি। ওখান থেকে পুজো সেই কারণে
শ্যামবাজারের বাড়ীতে সরিয়ে আনা হয়।
আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের পারিবারিক অবস্থা বেশ খারাপ হতে শুরু করে। এজন্য
আমি নিজেকে আজও ভাগ্যবান মনে করি। হয়ত সেটা না হলে আমি অন্যদের কষ্ট অনুভব করতে
শিখতাম না। পুজোর ভিড়ে তাই আমি খুব সহজেই একাত্ম হতে পারতাম তাদের সঙ্গে, যাদের
কিছু নেই।
আমার বাবা বলতেন ঈশ্বরের কাছে কখনও শুধু নিজের
ভালো চাইতে নেই।মন থেকে সবার ভালো চাইতে হয়। আমিও তাই চাইতাম। রোজ রোজ নিজের কথা
ভুলে সবার জন্য এই চাওয়ার মধ্যে যে কত বড় আনন্দ আছে তখন তা বুঝি নি। আর ওটাই বোধহয়
ছিল আমার সবসময়ের আনন্দের অজানা উৎস। নিজের খারাপ লাগা, বেদনা তার পাশে অনেক ছোট
হয়ে যেত। একটু একা থাকলেই হারিয়ে যেতাম আমার কল্পনার রাজ্যে, যেখানে মন খারাপের
কোন জায়গা নেই।
অনেকে বাইরে থেকে জানত না যে আমাদের ড্রয়িংরুমে
ঝাড়বাতির তলায় তখন শুধুই ছায়া, শুধুই অন্ধকার, শুধুই অভাব। ঘরের সেই অন্ধকার কোনকে আমি কিন্তু ভয় পেতাম না। শুধু বুঝেছিলাম এই
আলো - ছায়া দুটো মিলেই আমাদের জীবন। দুটোই
অনিত্য। অনেক সময় পুজোর সময়েও ওই নির্জনতাই ছিল আমার সঙ্গী, গভীর আত্মোপলব্ধির
জায়গা।
আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ী ছিল গোয়াবাগানের পুরনো পাড়ায়। ওই বাড়ী ছিল আমার
বাবার মেসোমশাই নলিনীকান্ত ব্রহ্মর। উনি ছিলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের ধর্ম ও দর্শনের
বিখ্যাত প্রফেসার। ওঁর লেখা হিন্দুধর্ম ও দর্শনের উপরে বেশ কিছু বিখ্যাত বই আছে।
ওঁকে আমি অবশ্য দেখি নি। ওঁদের বাড়ীতেও দুর্গাপুজো হত।
এখন বুঝতাম কেন বাবা আমাকে
ও দিদিকে ওখানে নিয়ে যেত। সৎসঙ্গ, ভালো
পরিবেশ ছোটদের মনের উপরে ভালো প্রভাব ফেলে। সেদিক দিয়ে ওই বাড়ী ছিল সত্যি ভালো অনেক
কিছু শেখার ল্যাবরেটরি। যেভাবে সেখানে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা হত, যেভাবে পারষ্পরিক
শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা হত, যেভাবে প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধের উপরে জোর দেওয়া হত, তার
গুরুত্ব তখন না বুঝলেও আজ বুঝি।
ওদের বাড়ীতে পুজো ওরা নিজেরাই করত। পুজোর প্রত্যেকটা আচার, রীতিনীতি সব কিছুই
নিখুঁতভাবে পালন করা হত। ওই পুজো উপলক্ষে পরিবারের লতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা অনেক দূরাত্মীয়
দেশ-বিদেশ থেকে আসত। আগে থেকে না চিনলেও, মুহূর্তের আলাপে আমরা সবাই যেন খুব বন্ধু
হয়ে যেতাম। ঠিক আমার বাবা- মার মতোই ওখানে কখনও কাউকে কারুর সম্বন্ধে নেগেটিভ কথা
বলতে শুনি নি। খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল ও বাড়ীতে।
ওই বাড়ীতে আমার এক খুব প্রিয়
বড়দিদি ছিল যে আমাদের সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেত। আমাদের সবাইকে চিলেকোঠার ঘরে
নিয়ে গিয়ে গল্প শোনাত।শক্ত শক্ত ধাঁধা দিত। পুজোর থেকে সেটাই ছিল বড় আকর্ষণ।
আমরা সবাই মিলে হইচই করে এমন ভাবে কাটাতাম যে পুজোর শেষে মন খারাপ হয়ে যেত।
মনে হত আবার কবে ওদের সঙ্গে দেখা হবে।
আগেই বলেছি যে আমাদের সেই সময় অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তাই পুজোতে নতুন জামা,
জুতো এসব তেমন হত না। অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবার ও সময় পেতাম না। কোন রকম ক্ষোভও ছিল
না।
আমাদের নিজেদের বাড়ী ছিল উত্তর কলকাতায় রামতনু বোস লেনে। চারদিকে পুজোর
প্যান্ডেল। পরপর বেশ কয়েকটা নামকরা পুজো। বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, সিমলা ব্যায়াম
সমিতি। ওই ক’দিন লোকের ভিড়ে যেন চেনা রাস্তাই অচেনা হয়ে যেত। আমার ভালো লাগত ভিড়ের থেকে দূরে খানিকটা একা একা সময়
কাটাতে। লক্ষ্য করতাম যাদের কিছু নেই, তাদের মধ্যেও যেন কিভাবে ওই আনন্দ ছড়িয়ে
পড়েছে। ফুটপাতে বসেও তারা যেন পুজোর আনন্দে মেতে আছে। আমার কেন জানি না এটা দেখে
খুব ভালো লাগত।
এসবের বাইরে ছিল সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা। মনে হত যেন সবার সঙ্গে দেখা
না হলে পুজোর আনন্দেই যেন কোথায় ফাঁক থেকে গেল।
এখন সেই পুজোর মধ্যের অন্তরঙ্গ আন্তরিকতাই
যেন সব থেকে বেশী মিস করি। এখানে ইংল্যান্ডে
কোন একটা পুজোতে যাই। দেখি সেই আন্তরিকতাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সবাই শুধু পুজোর
বাহ্যিক ব্যাপারটাতেই জোর দিচ্ছে। কিন্তু এটা তো মিলনের উৎসব? সেই জায়গাটাই গড়ে
ওঠে না যেখানে একজনের সঙ্গে আরেকজনের দূরত্ব কয়েকটা কথাতেই মুছে যাবে।
কে জানে এটা হয়ত শুধু ছেলেবেলাতেই সম্ভব। তখন তো মনের মধ্যে দেওয়াল গড়ে ওঠে
নি।
অভিজ্ঞান
রায়চৌধুরী
২-সেপ্টেম্বর-২০১৯
0 comments:
Post a Comment